লাইকি - টিকটক অ্যাপসের অপব্যবহার গড়ে উঠছে ভয়ঙ্কর কিশোর গ্যাং

লাইকি - টিকটক অ্যাপসের অপব্যবহার গড়ে উঠছে ভয়ঙ্কর কিশোর গ্যাং

আবদুল্লাহ আল মামুন।।

লাইকি - টিকটক অ্যাপসের অপব্যবহার গড়ে উঠছে ভয়ঙ্কর কিশোর গ্যাং। তথ্য-প্রযুক্তির উন্নয়ন মানবজীবনকে নানা ক্ষেত্রেই সহজ করলেও এর অপব্যবহারে ভয়ঙ্কর বিরূপ প্রভাব দেখা দিয়েছে সমাজে। জীবনমান সহজ করার পাশাপাশি ও সুস্থ বিনোদনের জন্য এসব প্রযুক্তিপণ্যের উদ্ভাবন হলেও একশ্রেণির মানুষ সেগুলো নেতিবাচক কাজেই বেশি ব্যবহার করছে।

বিশেষ করে বর্তমান সময়ে আলোচিত ‘টিকটক’ ও ‘লাইকি’র মতো অ্যাপস তৈরি হলেও শুরু থেকে প্রতিটি দেশেই এসবের নেতিবাচক ব্যবহার নিয়ে চলছে তীব্র সমালোচনা। বাংলাদেশেও একশ্রেণির উঠতি বয়সি কিশোর-কিশোরী ও তরুণ এসব অ্যাপসের নেতিবাচক ব্যবহার করে ভয়ঙ্কর অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। কোনো ধরনের বিধিনিষেধ না থাকায় এসব অ্যাপসের অপব্যবহার করে গড়ে তোলা হচ্ছে ‘ভয়ঙ্কর কিশোর গ্যাং’। সর্বশেষ গত রোববার উত্তরা এলাকায় রাস্তা বন্ধ করে।

 টিকটক ভিডিও করার সময় এক প্রকৌশলীসহ স্থানীয় লোকজনকে মারধর করার অভিযোগ উঠে ‘অপু ভাই’ নামে এক টিকটকার ও তার অনুসারীদের বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় মামলা হলে সোমবার এক সহযোগীসহ অপুকে গ্রেফতারের পর বিষয়টি ফের আলোচনায় উঠে আসে।

সমাজবিজ্ঞানী ও অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, মূলত সুস্থ বিনোদন ও সমাজের নানা ইতিবাচক চিত্র উপস্থাপনের জন্য তৈরি হলেও ‘টিকটক’ ও ‘লাইকি’র মতো তথাকথিত অ্যাপসগুলোর মাধ্যমে তৈরি করা হচ্ছে নানা ধরনের সস্তা ও অশালীন কনটেন্ট। এসব কনটেন্টের অশালীন উপস্থাপনা ও আচরণ শিশু-কিশোরসহ সব শ্রেণির মানুষের মধ্যে নেতিবাচক ও বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে।
অন্যদিকে এসব সস্তা কনটেন্টের অভিনেতা-অভিনেত্রীরা নিজেদের ফলোয়ার তথা অনুসারীদের অবস্থান ধরে রাখা ও সংখ্যা বাড়াতে গিয়ে পরস্পরের মধ্যে দ্ব›দ্ব ও সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ছে। এর মধ্যে অপু ভাই ও প্রিন্স মামুনের অনুসারীদের মধ্যে কয়েক দফায় বড় ধরনের মারামারি ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। বিষয়টি নিয়ে অভিযোগ ওঠায় অপু ও মামুনসহ বাংলাদেশি ৪টি আইডি বাতিল করেছে লাইকি কর্তৃপক্ষ। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রীয়ভাবে সুস্থ বিনোদনের ব্যবস্থার পাশাপাশি উঠতি বয়সিদের আচরণের ওপর নজরদারি বাড়ানো হলে এ ধরনের অপরাধের মাত্রা অনেক কমবে বলে মনে করছেন অপরাধ বিজ্ঞানীরা।

অন্যদিকে সমালোচিত টিকটক অ্যাপ থেকে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়া সব ধরনের অশালীন কনটেন্ট বা ভিডিও সরিয়ে ফেলা এবং এগুলো তৈরিতে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সরকারকে আইনি নোটিস পাঠানো হয়েছে।

পর্যালোচনায় দেখা গেছে, টিকটক ও লাইকির কনটেন্ট নিয়ে সমালোচনা শুরু হলে গত কয়েক দিন ধরে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, প্রাইমারি স্কুল থেকে শুরু করে বিভিন্ন বয়সি মানুষ এসব মাধ্যম ব্যবহার করে ভিডিও তৈরি করেছেন। বেশিরভাগ ভিডিওর কনটেন্ট অত্যন্ত নিচুমানের ও অশালীনতাপূর্ণ। আবার এসব সস্তা কনটেন্টের অনুসারীদের বেশিরভাগ নিম্ন আয়ের পরিবার থেকে আসা। টিকটক ও লাইকিতে নিজেদের অবস্থান প্রথম দিকে রাখতে ও ফলোয়ার সংখ্যা বাড়াতে তথাকথিত এসব ‘সেলিব্রিটি’ প্রায়শই উসকানিমূলক ভিডিও শেয়ার করেছেন। এতে বিভিন্ন ‘সেলিব্রিটি’দের অনুসারীদের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে বড় ধরনের মারামারি ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। কিছুদিন আগে গুলিস্তানে টিকটকার অপুর অনুসারীদের মারধরের অভিযোগ উঠে মামুনের অনুসারীদের বিরুদ্ধে। পরববর্তী সময়ে মামুনের অনুসারীরাও অপুর অনুসারীদের মারধর করে।

ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের সমাজকল্যণ ও গবেষণ ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক সমাজ ও অপরাধ গবেষক তৌহিদুল হক বলেন, টিকটক ও লাইকির মতো অ্যাপসগুলো ইতিবাচক কাজের জন্য তৈরি হলেও রাষ্ট্রীয় নীতিমালা ও সামাজিক শিষ্টাচারের ঘাটতি থাকায় আমরা বরাবরের মতো নেতিবাচক কাজে ব্যবহার করছি। এর প্রভাবে দীর্ঘদিন ধরে নানা ধরনের গ্যাংভিত্তিক কিশোর অপরাধসহ অন্যান্য অপরাধ সংঘটিত হলেও এতদিন বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরে আসেনি।

ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের এই অপরাধ গবেষক বলেন, শিশু-কিশোর ও তরুণ-তরুণীদের পোশাক, চাল-চলন, আচার-ব্যবহার, চুলের কাটিং কেমন হবেÑ সে বিষয়ে পরিবার ও সমাজের নজরদারি থাকা উচিত। এ ছাড়া পরিবারবঞ্চিত শিশু-কিশোর ও তরুণদের জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে সহযোগিতা ছাড়াও বিভিন্ন এনজিও এগিয়ে এলে অপরাধ হ্রাস সম্ভব হবে।

তৌহিদুল হক বলেন, ১৮ বছরের আগের কিশোর-তরুণদের উচ্চ প্রযুক্তিসম্পন্ন পণ্যের ব্যবহার থেকে সরিয়ে রাখতে পরিবারকে জোরালো ভ‚মিকা রাখতে হবে। এ ছাড়া এসব অ্যাপসের মাধ্যমে নেতিবাচক ব্যবহার বন্ধ করে সমাজ ও বাস্তবিক প্রেক্ষাপটে দেশীয় মূল্যবোধের নির্দিষ্ট কাঠামোর মাধ্যমে ভালো কনটেন্ট তৈরির দিকে তরুণ সমাজকে আগ্রহী করা গেলে বর্তমানে চলমান নেতিবাচক অবস্থার পরিবর্তন সম্ভব হবে।

অশালীন কনটেন্ট সরানো ও জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আইনি নোটিস : বুধবার সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী মো. মনিরুজ্জামান লিংকন সরকারের তরফ থেকে তথ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং তথ্য, যোগাযোগ ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের আইসিটি বিভাগকে পাঠানো আইনি নোটিসে বলা হয়েছেÑ এসব অ্যাপের সঠিক ব্যবহার না করায় সমাজের একটি বড় অংশ বিশেষত তরুণ প্রজন্ম অনেক ক্ষেত্রে বিপথগামী হচ্ছে। এর মাধ্যমে এমন কিছু অশ্লীল কনটেন্ট তৈরি করা হচ্ছে যাতে আমাদের কোমলমতি শিশু-কিশোর ও যুবক শ্রেণি বিপথগামী হচ্ছে এবং নানারকম অপকর্মে জড়িয়ে পড়ছে। নোটিসপ্রাপ্তির ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে টিকটক থেকে সব ধরনের অশালীন কনটেন্ট সরানোসহ জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলেও নোটিসে উল্লেখ করা হয়েছে।

অপু ও মামুনের লাইকি আইডি বাতিল : লাইকি বাংলাদেশের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে দেখা গেছে, গত মঙ্গলবার বিকালে অপু ভাই ও প্রিন্স মামুনসহ বিতর্কিত চারজনের আইডি বাতিল করার ঘোষণা দিয়েছে লাইকি কর্তৃপক্ষ।

লাইকি জানায়, সম্প্রতি কয়েকজন তরুণের বিরুদ্ধে কিছু অভিযোগ এবং বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির সংবাদে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের অনুরোধে ৪টি আইডি বাতিল করা হয়েছে।