‘লাসুবন’ সম্প্রতি সন্ধান পাওয়া শ্রীমঙ্গলের নতুন গিরিখাত

‘লাসুবন’ সম্প্রতি সন্ধান পাওয়া শ্রীমঙ্গলের নতুন গিরিখাত
‘লাসুবন’ সম্প্রতি সন্ধান পাওয়া শ্রীমঙ্গলের নতুন গিরিখাত

প্রতিনিধি, শ্রীমঙ্গল ।।

শ্রীমঙ্গল উপজেলার দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় প্রাচীন কয়েকটি গিরিখাতের সন্ধান পাওয়া গেছে। খাসি ভাষায়, লাসুবন বা পাহাড়ি ফুল বা জংলি ফুল নামে এই এলাকায় রয়েছে ছোট-বড় অনেকগুলো পাথুরে ছড়া। এর মধ্যে বড় তিনটি গিরিখাত সম্প্রতি নজরে এসেছে সবার। এলাকাটি পর্যটনের অন্যতম আকর্ষনীয় স্থান হতে পারে বলে ধারণা সংশ্লিষ্টদের। তবে প্রাণ-প্রকৃতি রক্ষা করেই নতুন এই পর্যটন স্পটের উন্নয়নের কথা বলছেন পরিবেশবাদীরা। আবার কেউ কেউ বলছেন, এখানে পর্যটকদের যাওয়াটা ঠিক হবে না। কারণ এখানে যাওয়াটা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ।

সম্প্রতি যেভাবে এটির সন্ধান পাওয়া যায় :

মাসাধিক কাল আগে শ্রীমঙ্গলে ক্ষুদ্র নৃ-ত্বাত্তিক জনগোষ্ঠীর উপজেলা সমন্বয়কারী তাজুল ইসলাম জাবেদ জানান, শ্রীমঙ্গলের পাহাড়ের গভীর অরণ্যে খুব সুন্দর কিছু জায়গা রয়েছে। তিনি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীকে নিয়ে কাজ করার সময় একবার গভীর জঙ্গলে গিয়ে তা দেখেন এবং তার কাছে খুব ভালো লাগে। বিষয়টি তিনি গণমাধ্যমকর্মীদের জানালে তারা ওই স্থানে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দেন এবং তিনি সম্মত হন। আর এভাবেই গিরিখাতটির সন্ধান পান গণমাধ্যমকর্মীরা।

জায়গাটির অবস্থান ঢাকা থেকে প্রায় ২১৫ কিলোমিটার, মৌলভীবাজার জেলা শহর থেকে ৪৫ কিলোমিটার ও শ্রীমঙ্গল উপজেলা শহর থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরে। ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সীমান্তবর্তী সিন্দুরখান ইউনিয়নের ঘন জঙ্গলবেষ্ঠিত পাহাড়ি এলাকা এটি। প্রথমে জীপ বা মোটরসাইকেল নিয়ে, তারপর পায়ে হেঁটে কয়েক কিলোমিটার যেতে হয়। হাঁটার পথ পাহাড়ি ছড়া ও খাড়া পাহাড়-টিলাবেষ্টিত।

গিরিখাত নিয়ে স্থানীয় আদিবাসী খাসিয়াদের কথা :

গিরিখাতগুলোর কোনোটা এক কিলোমিটার, আবার কোনোটা এর চেয়ে কম বলে জানান স্থানীয় পাহাড়বাসী এডিসন তারিয়াং ও ফেরলি সুরং। তারা বলেন, বহু বছর ধরে বংশানুক্রমিকভাবে তারা ওই এলাকায় বসবাস করছেন। এই গিরিখাতগুলো যোগাযোগবিচ্ছিন্ন স্থানে পড়েছে। সেখানে তাদেরও খুব একটা যাওয়া হয় না। আর সেখানে যাওয়ার ঝুঁকিও রয়েছে। নিচে নামলে হঠাৎ যদি উপর থেকে পানি নামে, তাহলে কিছু কিছু জায়গা আছে খাড়া পাথরের পাহাড়। উপরে ওঠার কোনো পথ থাকে না। এতে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।

তারা আরও জানান, গিরিখাত শব্দের সঙ্গে তারা পরিচিত ছিলেন না। এটি যে গিরিখাত তা তারা প্রথম জানলেন।

সম্প্রতি নৈসর্গিক জায়গাটি ঘুরে দেখে এবং স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পুরো জায়গাটি পড়েছে স্থানীয় নাহার খাসিয়া পুঞ্জির ভেতরে। খাসি ভাষায় লাসুবন বা পাহাড়ি ফুল নামে ডাকা হয় এলাকাটিকে। একটি পাহাড়ি ছড়া ধরে পুরো এলাকাটি ঘুরে আসা যায়। এই লাংলিয়াছড়া ভারতের ত্রিপুরা থেকে নেমে এসেছে। প্রায় ২৫ কিলোমিটার পথ বেয়ে মিশেছে শ্রীমঙ্গলের বিলাস ছড়ায়। সাপের মতো আঁকাবাঁকা ছড়ায় মিশেছে প্রায় শ’খানেক ছোট-বড় পাথুরে ছড়া। এর মধ্যে কয়েকটি গিরিখাত রয়েছে। স্থানীয় খাসি ভাষায় ক্রেম ক্লু, ক্রেম কেরি ও ক্রেম উল্কা নামে বড় তিন গিরিখাত পর্যটকদের কাছে মূল আকর্ষন হতে পারে। পাহাড় থেকে শ’পাঁচেক নিচে এসব গিরিখাত কোথাও বড় আবার কোথাও সরু। রয়েছে ছোট ছোট ঝিরিধারায় অবিরাম জলের শব্দ। তবে বর্যা মৌসুমে পানির প্রবাহ বেশি থাকে পাহাড়ের বুক বেয়ে নেমে আসা ছোট ঝিরিগুলোতে।

স্থানীয়রা জানান, পুরো এলাকায় আছে ছোট-বড় অর্ধশত ঝিরিধারা। পাহাড় বেয়ে নেমে আসা এসব ঝিরির সবচেয়ে বড়টিকে স্থানীয়রা ডিবারমিন ঝর্ণা নামে ডাকেন।

আসলম নাহার খাসিয়া পুঞ্জির মান্ত্রী (গ্রাম প্রধান) ডিবারমিন পতাম বলেন, খাসিয়ারা প্রকৃতির সন্তান। জায়গাটিকে আমরা যত্নে রেখেছি, প্রকৃতি ও পরিবেশের কোনো ক্ষতি হতে দেইনি। এখানে পর্যটনের উন্নয়ন হোক, তাতে আমাদের সমস্যা হবে না। তবে পরিবেশের বিয়ষটি সবার আগে গুরুত্ব দিতে হবে। নয়তো আমাদের জীবন-জীবিকা ঝুঁকিতে পড়তে পারে। কারণ আমাদের মতো বনজীবীদের কাছে প্রকৃতিই সব।

তিনি আরও বলেন, স্থানীয় নাহার চা-বাগানের সঙ্গে আমাদের ভূমি নিয়ে সমস্যা রয়েছে। দীর্ঘদিনের এই সমস্যাটি মীমাংসা করার জন্য আমরা আবেদন করছি। আর সরকার যাই করুক, যেন আমাদের সঙ্গে নিয়ে করে। কারণ এই এলাকায় কোথায় কি আছে সেটা আমরা ভালো জানি। আমাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমেই যেন সব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।

উল্কা গিরিখাতের উদ্দেশে একদিন ভ্রমণ করে এলাকায় আবিষ্কার হয় একাধিক গিরিখাত, ঝর্না বা ঝিরিসদৃশ জলপ্রপাত। খাসিয়াদের কাছ থেকে আমরা জানতে পারি এই অরণ্যে এ রকম আরও অনেক জায়গা রয়েছে। একটি জিপ গাড়ি নিই আমরা। আসলম নাহার খাসিয়া পুঞ্জির জনবসতিতে গিয়ে সেখানে গাড়ি রেখে হাঁটতে শুরু করি। পাহাড় বেয়ে নেমে ছড়ায় গিয়ে পৌঁছতেই শুরু হলো পাথুরে পানির ভেতর দিয়ে হাঁটা। খাড়া পাহাড়ি টিলা। খাড়া ঢালে পাহাড়িরা পা রাখার মতো ছোট ছোট খোপ করে রেখেছেন। এই খোপগুলো পাথরে পরিণত হয়েছে। নিচের দিকে তাকালে ভয়ের সঞ্চার হলেও শেষমেশ নিরাপদে নামতে পারায় মনে আসে বিজয়ের তৃপ্তি।

আমাদের দলে বেশ কয়েকজন ছিলেন স্থানীয় খাসিয়া জনগোষ্ঠীর সন্তান। সব মিলিয়ে আমরা ১০ জন। বামদিকে একটু সামনে এগোতেই আমরা প্রবেশ করি যেন সেই প্রস্তর যুগে। দুইপাশে খাড়া পাহাড় পাথরে পরিণত হয়েছে। বৃষ্টি নেই, তবুও অনবরত টুপ টুপ করে পানির বড় বড় ফোঁটা পাথরের গা থেকে নিচে পড়ছে। এর পাশের পাহাড়ের উচ্চতাও অনেক। সূর্যের আলো এখানে লুকোচুরি খেলে। একেবারে নিচের বা ভেতরের অংশে সূর্যের আলো পৌঁছার সুযোগ নেই। স্থানীয়রা এটিকে উল্কা বলে ডাকেন।

ঠিক সেখানেই পুঞ্জির প্রধান আমাদের বিকেলের খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করলেন। প্রাকৃতিক পরিবেশে বসে খাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তাই সবাই এক সঙ্গে দাঁড়িয়ে খেয়ে নিলাম। এরকম অভিজ্ঞতা একেবারে নতুন সবার কাছে।

নতুন এই গিরিখাত সম্পর্কে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম বলেন, শ্রীমঙ্গল উপজেলায় পর্যটনের নতুন একটি দ্বার উন্মোচিত হলো। বাংলাদেশে এ রকম গিরিখাতের সন্ধান এখন পর্যন্ত নেই। সেক্ষেত্রে এটাই প্রথম। বিষয়টি আমি সরকারের উর্ধ্বতন পর্যায়ে এবং পর্যটন কর্পোরেশনকে জানাবো। যেহেতু এটি দুর্গম এলাকা, রাস্তাঘাটও নেই, তাই প্রশাসনের অনুমতি ছাড়া এখানে পর্যটকদের আসা উচিৎ হবে না।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) মৌলভীবাজারের সমন্বয়ক আ স ম সালেহ সোহেল বলেন, মৌলভীবাজারে সম্প্রতি নতুন নতুন অনেক প্রাকৃতিক পর্যটন স্পটের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে। সেটার দু’টো দিক রয়েছে। এটি পর্যটনের জন্য সুখবর হলেও প্রাণ-প্রকৃতির জন্য সুখবর নয়। আমাদের পর্যটকদের বড় একটা অংশ প্রকৃতিকে যত্ন করতে জানেন না বা খামখেয়ালিপনার স্বভাব তাদের। পর্যটনের নামে প্রকৃতি যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, এ বিষয়টি প্রথমেই মাথায় রাখতে হবে।

তিনি আরও বলেন, নাহারে সন্ধান পাওয়া স্থানটিকে গিরিখাত বলা যাবে কি না সেটা নিয়ে মতপার্থক্য রয়েছে। বিষেশজ্ঞ পরিদর্শনের মাধ্যমে ক্যাটাগরি নিশ্চিত করা প্রয়োজন। একই সঙ্গে স্থানীয় আদিবাসীদের জীবন-জীবিকায় যাতে কোনো ব্যাঘাত না ঘটে, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য সেখানে পর্যটকদের প্রবেশাধিকার সীমিত রাখা প্রয়োজন।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল করিম কিম বলেন, এই জায়গাটি অত্যন্ত দুর্গম। এখনও কোনো রাস্তাঘাট হয়নি। কাজেই এখানে যাওয়াটা খুব ঝুঁকিপূর্ণ। আমি চাইবো সেখানে যেন পর্যটকদের প্রবেশে বাধা দেওয়া হয়। এই বনাঞ্চল সংরক্ষিত হিসেবে থাকা উচিত।

মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক নাজিয়া শিরিন বলেন, দুর্গম সীমান্তবর্তী এই স্থানে এখনও রাস্তাঘাট গড়ে ওঠেনি। সে কারণে কেউ যাতে ঝুঁকি নিয়ে আপাতত সেখানে না যান, আমরা সেই পরামর্শ দিয়েছি। রাস্তাঘাট তৈরিসহ উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের পর সীমিত আকারে পর্যটকদের প্রবেশের অনুমতি প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করব।