শীতজনিত শিশুর ডায়রিয়া

শীতজনিত শিশুর ডায়রিয়া

অধ্যাপক ডা. মো. খালেদ নূর ।। 

অন্যান্য রোগের পাশাপাশি তীব্র শীতে শিশুদের শীতজনিত ডায়রিয়া হয়। এ সময় বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করলে এ ধরনের ডায়রিয়া ঠেকানো যায়। আবার সঠিক সময়ে চিকিৎসা দিলে পুরোপুরি সেরে যায়।
মোনিয়া, ব্রংকিওলাইটিস ইত্যাদি রোগের পাশাপাশি ডায়রিয়ায়ও প্রচুর শিশু আক্রান্ত হয়, যাকে বলে কোল্ড ডায়রিয়া।

ডায়রিয়ায় যে পানি শূন্যতা লক্ষ্য
কারণ

কোল্ড ডায়রিয়ার তেমন সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ নেই। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ‘এডিনো’ ভাইরাসকে দায়ী করা হয়। এই ভাইরাস ঠান্ডা যেমন ঘটায়, আবার ডায়রিয়াও ঘটায়।
 
চিকিৎসা
শীতজনিত ডায়রিয়া বা কোল্ড ডায়রিয়ার বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তেমন কোনো চিকিৎসার দরকার হয় না। এর চিকিৎসা খুবই সাধারণ এবং তা হলো, মুখে খাওয়ার স্যালাইন ও জিংক খাওয়ানো। ছয় মাসের কম বয়সি শিশুর ক্ষেত্রে শুধু মায়ের বুকের দুধ ও অল্প অল্প খাবার স্যালাইন খেতে দিতে হবে। এতেই ডায়রিয়া ভালো হয়ে যায়, অন্য কোনো ওষুধ দেওয়া লাগে না। ডায়রিয়া সেরে যেতে সাধারণত পাঁচ থেকে সাত দিন এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে দুই সপ্তাহের মতো সময় লাগে।

এই সময় সম্ভব হলে খাওয়ার স্যালাইনের পাশাপাশি ভাতের মাড়, চিঁড়ার পানি, ডাবের পানি, ফলের রস, কাঁচা কলার ভর্তা ইত্যাদি খেতে দিন। খাবার স্যালাইন ঘরে না থাকলে হাতে তৈরি স্যালাইন বানিয়ে পান করান। জ্বর থাকলে প্যারাসিটামল-জাতীয় জ্বরের সিরাপ, ঠান্ডার জন্য অ্যান্টিহিস্টামিন সিরাপও দেওয়া যেতে পারে। শুরুতেই খাওয়ার স্যালাইন খাওয়ালে পানি শূন্যতা দেখা দেয় না।

কখন হাসপাতালে?
কিছু ডায়রিয়ার ক্ষেত্রে শিশুকে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করাতে হয়। নচেৎ সে ঝুঁকির মধ্যে পড়ে। কিন্তু কখন হাসপাতালে নিতে হবে, সে বিষয়ে অনেকে অবগত নয়। সাধারণত যখন শিশুকে হাসপাতালে দ্রুত ভর্তি করে চিকিৎসা দেওয়ার প্রয়োজন হয়, তা হলো।

♦ খুব বেশি পানির মতো পাতলা পায়খানা অনবরত হতে থাকলে।
♦ শরীর অতিরিক্ত পানিশূন্য হয়ে নিস্তেজ হলে।
♦ প্রস্রাবের পরিমাণ কমে গেলে বা একেবারেই প্রস্রাব না হলে।
♦ মুখ ও জিব শুকিয়ে গেলে।
♦ স্যালাইন বা অন্য কোনো খাবার একেবারে খেতে না পারলে।
♦ খুব বেশি বমি করলে, এমনকি স্যালাইন খেয়েও বমি হলে বা অবস্থা বেশি খারাপ মনে হলে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করাতে হয়।

কিছু ভুল ধারণা
♦ শিশুর ডায়রিয়া হলে অনেকে খাওয়া-দাওয়া কমিয়ে দেন বা নানা বিধি-নিষেধ আরোপ করেন, যা মোটেই ঠিক নয়।
♦ অনেকে ডায়রিয়া হলে শিশুকে মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানো একেবারেই বন্ধ করে দেন, এটাও শিশুর জন্য বিপজ্জনক ও ক্ষতিকর।
♦ বমি হলে অনেকে স্যালাইন বন্ধ করে দেন তা করা যাবে না। বরং বমি বন্ধ হলে বা কিছু ক্ষণ অপেক্ষা করে অল্প অল্প করে খাওয়ার স্যালাইন দিন।
♦ অনেকে স্যালাইনের কিছু অংশ পানির সঙ্গে গুলিয়ে পান করায়, যা মোটেও ঠিক নয়। এতে স্যালাইনে লবণের পরিমাণ বেশি হয়ে শিশুর ব্রেনে মারাত্মক সমস্যা হতে পারে। বরং শিশু যতটুকুই পান করুক না কেন, স্যালাইনের পুরো অংশ পরিমাণ মতো পানির সঙ্গে মিশিয়ে সেই পানি বারবার খাওয়াতে হবে। নির্দিষ্ট সময় পর স্যালাইন মেশানো বাকি পানি ফেলে দিতে হবে।
♦ চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনো ওষুধ দেওয়া যাবে না। মনে রাখতে হবে, ভাইরাসজনিত কোল্ড ডায়রিয়ায় অ্যান্টিবায়োটিকের কিন্তু কোনো ভূমিকা নেই।

প্রতিরোধে করণীয়
♦ যেহেতু ঠান্ডার কারণে কোল্ড ডায়রিয়া হয়, সেহেতু যেকোনোভাবেই হোক, এই শীতের সময় শিশুকে ঠান্ডা বা শীতের অতিরিক্ত প্রকোপ থেকে রক্ষা করতে হবে। সব সময় পর্যাপ্ত গরম পোশাকে শিশুকে আবৃত করে রাখতে হবে।
♦ স্যাঁত সেঁতে ঘরে বা ঘিঞ্জি পরিবেশে বসবাস করা যাবে না।
♦ শীতের সময় শিশুর গোসলে হালকা গরম পানি ব্যবহার করা ভালো। প্রতিদিন গোসল করানোর দরকার নেই।
♦ সর্দি, হাঁচি, কাশি, জ্বর দেখা দিলেই সতর্ক হতে হবে। এ সময় নকে-মুখে রুমাল ব্যবহার করতে হবে। প্রয়োজনে নেবুলাইজার ব্যবহার করা যেতে পারে বা চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।
♦ শিশুকে সব সময় স্বাভাবিক ও টাটকা খাবার খাওয়াতে হবে। খাবার সব সময় ঢেকে রাখতে হবে, যাতে মশা-মাছি না বসে। বাইরের খোলা খাবার শিশুকে কখনও খাওয়াবেন না। ঘরে তৈরি খাবার খাওয়ানোই শ্রেয়।
♦ মায়ের বুকের দুধ পান করাতে হবে।
♦ গরুর দুধ ঘন না করে বরং একটু পাতলা করে পান করানো উচিত।
♦ শিশুর খাবার পানি ফুটিয়ে পান করাতে হবে।

লেখক : শিশুরোগ বিভাগের প্রধান