সীতাকুণ্ডে সরকারি ভুর্তকির যন্ত্র অকৃষকের কাছে, ভুর্তকি সুবিধা পাননি কৃষক!

সীতাকুণ্ডে সরকারি ভুর্তকির যন্ত্র অকৃষকের কাছে, ভুর্তকি সুবিধা পাননি কৃষক!
সীতাকুণ্ডে সরকারি ভুর্তকির যন্ত্র অকৃষকের কাছে, ভুর্তকি সুবিধা পাননি কৃষক!

মেজবাহ উদ্দীন খালেদ, সীতাকুণ্ড ।। 

কৃষিতে শ্রমিক সংকট লাঘবে সহজে ব্যবহার্য ও টেকসই কৃষি যন্ত্রপাতি সুলভে সহজপ্রাপ্য করতে সরকার কৃষি যান্ত্রিকীকরণ নীতিমালা ২০২০ অনুমোদন দেয়। এর আওতায় ৩ হাজার ২০ কোটি টাকার একটি প্রকল্পও নেওয়া হয়। কৃষিযন্ত্র বিতরণে ২০২০ সালের ৮ আগস্ট থেকে সারা দেশে আবেদন সংগ্রহ শুরু হয়। ১২ ধরনের যন্ত্রে সরকার ৫০ থেকে ৭০ শতাংশ অর্থ দিচ্ছে। অর্থাৎ ১ কোটি ৯৯ লাখ টাকা দামের কৃষিযন্ত্রে সরকারের ভর্তুকি ১ কোটি ২৯ লাখ ৩৫ হাজার টাকা।

এই যন্ত্র কৃষক কিনতে পারছেন ৬৯ লাখ ৬৫ হাজার টাকায়। এ ক্ষেত্রে উপকূলীয় এলাকা হিসেবে ৭০ শতাংশ ভর্তুকি দেওয়া হয়েছে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড  উপজেলায়। উপজেলার কয়েকজন কৃষক অভিযোগ করেন, কৃষিযন্ত্র কিনতে ৭০ শতাংশ ভর্তুকি সুবিধা পাননি অনেকে। বরং কোনো কোনো যন্ত্রের মূল্য ধরা হয়েছে দ্বিগুণের চেয়ে বেশি। আর মূল দাম থেকেও ৩০ হাজার টাকা বেশি দিয়েই পাওয়ার থ্রেসার কিনেছেন কৃষকরা। তবে আসলেই কৃষকরা কি এই সুবিধা পাচ্ছেন, নাকি অকৃষকরা ঋণ সুবিধাসহ ভর্তুকির কৃষিযন্ত্র কিনছে, কৃষিযন্ত্রগুলো কি টেকসই-এসব প্রশ্নের কোনো সুস্পষ্ট উত্তর মেলেনি কৃষি কর্মকর্তাদের কাছে। 

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, যেসব যন্ত্র ভর্তুকি মূল্যে পাওয়া যাবে সেগুলোর মধ্যে আছে কম্বাইন্ড হারভেস্টার, রাইস ট্রান্সপ্লান্টার, পাওয়ার থ্রেসার, মেইজ শেলার, রিপার ও রিপার বাইন্ডার, ড্রায়ার, পাওয়ার স্প্রেয়ার, পাওয়ার উইডার, সিডার, বেড প্লান্টার ও ক্যারেট ওয়াশার। আবেদনের ক্ষেত্রে শর্ত পাসপোর্ট সাইজের ছবি দুই কপি, মোবাইল নম্বর, কৃষি কার্ড ও জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি দিতে হবে। তবে এসব কিছুই মানা হয়নি সীতাকুণ্ডে  ভর্তুকি মূল্যে কৃষিযন্ত্র বিতরণের ক্ষেত্রে। উপজেলা কৃষি অফিস থেকে গত বছরের আগস্টে ভর্তুকির কৃষিযন্ত্র পেয়েছেন ১২ জন। 
সীতাকুণ্ড  উপজেলার সৈয়দপুর ইউনিয়নের মহানগর গ্রামের বাসিন্দা মো. মামুন একজন ব্যবসায়ী।

কোনো ধরনের কৃষিজমি না থাকলেও উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর থেকে তিনি পেয়েছেন ৭০ শতাংশ ভর্তুকি মূল্যের দুটি কৃষিযন্ত্র। আর এসব কৃষিযন্ত্র এলাকায় চড়া দামে ভাড়া দিয়ে তিনি চালাচ্ছেন জমজমাট ব্যবসা। এ ক্ষেত্রে অধিদফতর থেকে মানা হয়নি কোনো নিয়ম। এলাকার প্রভাবশালী, রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত থাকার কারণে তাকে যন্ত্র দুটি দেওয়া হয়েছে। তবে মো. মামুন উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরে প্রভাব খাটিয়ে একটি কৃষি যন্ত্র নিয়েছেন নিজের নামে, অন্যটি নিয়েছেন কৃষির সঙ্গে সম্পর্ক না থাকা নিজের দোকানের কর্মচারী সাইফুল ইসলামের নামে।

মামুনের নামে বরাদ্দকৃত একটি ট্রাক্টর ও সাইফুল ইসলামের নামে বরাদ্দকৃত একটি পাওয়ার থ্রেসার (ধান মাড়াই মেশিন) দেখতে গেলে উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের দেওয়া তালিকা অনুযায়ী মোবাইল ফোনে কল করা হয় সাইফুল ইসলামকে। তার কথা মতে তার সৈয়দপুর ইউনিয়নের ঠিকানায় গিয়ে দেখা যায় পাওয়ার থ্রেসারটি সাইফুল ইসলাম নয় এটি মামুন হোসেনের নিয়ন্ত্রণে। মোবাইলের নম্বর নিয়ে যোগাযোগ করা হলে যিনি এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলেন তিনি সাইফুল ইসলাম নন, মামুনই।

কৃষিযন্ত্র বিতরণের তালিকায় সাইফুল ইসলামের নামে একটি পাওয়ার থ্রেসার বরাদ্দ দেওয়া হলেও সাইফুল ইসলামের  মোবাইল নম্বরের বদলে তালিকায় দেওয়া হয়েছে মো. মামুনের  ফোন নম্বর। অন্যদিকে মো. মামুনের নামেও একই ফোন নম্বর দিয়ে একটি সিডারও (ট্রাক্টর) বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এ দুটি কৃষিযন্ত্রই বর্তমানে মামুনের নিয়ন্ত্রণেই রয়েছে। সীতাকুণ্ডে  শুধু মামুন নয়, ভর্তুকি মূল্যে কৃষিযন্ত্র বিতরণে ব্যাপক অনিয়ম ও জালিয়াতির অভিযোগ পাওয়া গেছে। উপজেলা কৃষি অফিসের কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে কৃষক না হয়েও এলাকার প্রভাবশালী, ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা নিয়েছেন বেশিরভাগ কৃষিযন্ত্র।

সীতাকুণ্ড  উপজেলা কৃষি অফিসারের কার্যালয় থেকে ২০২১ণ্ড ২২ অর্থবছরে ভর্তুকি মূল্যে কৃষিযন্ত্র বিতরণের তালিকায় দেখা যায়, সৈয়দপুরের হাজারীহাটের মো. মহিউদ্দিন ও বড় দারোগারহাটের আবদুল আলিম পেয়েছেন একটি করে পাওয়ার থ্রেসার। মহিউদ্দিনের পাওয়ার থ্রেসারটি দেখতে গেলে সেটি তার কাছে পাওয়া যায়নি। মো. মহিউদ্দিনের জাতীয় পরিচয়পত্র যাচাই করে তালিকার সঙ্গে মেলালে বড় ধরনের অসঙ্গতি ধরা পড়ে। মো. মহিউদ্দিনের এনআইডি নম্বরটি কৃষি অফিসের তালিকার সঙ্গে মেলা তো দূরের কথা তার এনআইডি কার্ডটি কম্পিউটার কম্পোজ করে দোকানে বানানো। উপজেলা কৃষি অফিস থেকে দেওয়া পাওয়ার থ্রেসার দেখতে চাইলে মো. মহিউদ্দিন অন্য একটি পাওয়ার থ্রেসার দেখিয়ে দেন। যেটির ইঞ্জিন নম্বর, চেসিস নম্বরের সঙ্গে তালিকায় দেওয়া ইঞ্জিন ও চেসিস নম্বর মেলেনি। এমন অসংগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে মো. মহিউদ্দিন নিজ মুখে স্বীকার করে নিয়েছেন ওই যন্ত্রটি কৃষি অফিসের দেওয়া নয়। কৃষি অফিস থেকে দেওয়া যন্ত্রটি তিনি অন্য এলাকায় ভাড়া দিয়েছেন। অন্যদিকে পাওয়ার থ্রেসার পাওয়া আবদুল আলিমকে অনেক চেষ্টা করেও খুঁজে পাওয়া যায়নি। তালিকায় দেওয়া মোবাইল নম্বরটিও লাগাতার বন্ধ পাওয়া গেছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আবদুল আলিমের নামে বরাদ্দকৃত পাওয়ার থ্রেসার শুরু থেকেই তার নিয়ন্ত্রণে নেই। সেটি তিনি মো. মহিউদ্দিনের কাছে বিক্রি করে দিয়েছেন। 

এদিকে সীতাকুণ্ড  উপজেলায় সরকারি ভর্তুকির এসব কৃষিযন্ত্র কয়েকজন প্রকৃত কৃষককেও দেওয়া হয়েছে। তবে এসব বেশিরভাগ যন্ত্রাংশ দেওয়া হয়েছে নিম্নমানের। এতে অনেক যন্ত্র পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই অকেজো হয়ে পড়েছে। পাওয়ার থ্রেসারের স্টিয়ারিং নষ্ট হয়ে যাওয়ায় এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যন্ত্রটি নিয়ে যেতে পারছেন না কৃষকরা। ঘন ঘন পাওয়ার থ্রেসারের বেল্ট অকেজো হয়ে পড়ায় বাড়তি খরচ গুণতে হচ্ছে। কৃষকরা বলছেন, উপজেলা কৃষি অফিসের কথা মতে নওগাঁর আলিম ইন্ডাস্ট্রিজ থেকে সবকটি পাওয়ার থ্রেসার কিনে এনেছেন মো. মহিউদ্দিন। তবে যন্ত্রের গায়ে আলিম ইন্ডাস্ট্রিজ লেখা থাকলেও যন্ত্রগুলোর তৈরিকারক প্রতিষ্ঠান চাচাণ্ড ভাতিজা ইন্ডাস্ট্রিজ। নতুন যন্ত্র হলেও দ্রুত সময়ে স্টিয়ারিং নষ্ট হয়ে পড়েছে। চাকা, স্টিয়ারিং, গিয়ারবক্স, বেল্টসহ দেওয়া হয়েছে নিম্নমানের সব যন্ত্রাংশ। কৃষকদের অভিযোগ, উপজেলা কৃষি অফিস নিজে কেনার কথা থাকলেও পাওয়ার থ্রেসার কেনার দায়িত্ব দেওয়া হয় মাড়াই মেশিন ব্যবসায়ী মো. মহিউদ্দিনকে। তার কারসাজিতে নওগাঁর আলিম ইন্ডাস্ট্রিজ থেকে কম দামে পাওয়ার থ্রেসার কিনে দেওয়া হয়েছে কৃষকদের। 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে উপজেলা কৃষি অফিসার মো. হাবিবুল্লাহ বলেন, যারা যন্ত্র পেয়েছেন তারা কৃষক নয়, এ কথা সঠিক নয়। সরকারি হিসাবে আপনি আমি সবাই কৃষক। সীতাকুণ্ডে র সংসদ সদস্যও একজন কৃষক। সুতরাং যে কেউ চাইলে এসব যন্ত্র নিতে পারবে। কৃষকের উপকার হলেই হবে। 

বিতরণকৃত কৃষিযন্ত্র দেখভালের দায়িত্ব তার নয় জানিয়ে তিনি বলেন, এসব দেখার দায়িত্ব আমার নয়। আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে তালিকা দেখে বিতরণ করা। সরকারি ভর্তুকির টাকা আমরা পরিশোধ করেছি। আমার অফিস থেকে যন্ত্র নিতে কোনো ঘুষ দেওয়া হয়েছে কি না সেটি বিবেচ্য বিষয়। কে নিয়েছে সেটি বড় কথা নয়। তালিকায় ইঞ্জিন নম্বর ও কৃষকদের এনআইডি মিল না পাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এসব হয়তো টাইপিং মিসটেক। যা ভুল হয়েছে তা আমরা ঠিক করে নিব। এ সময় তিনি এ প্রতিবেদকের সামনে সংশ্লিষ্ট উপণ্ড সহকারী কৃষি কর্মকর্তাদের ডেকে অনিয়ম প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তারা কেউই সদুত্তর দিতে পারেননি। 

এ বিষয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর চট্টগ্রাম অঞ্চলের উপপরিচালক কৃষিবিদ মো. আক্তারুজ্জামান বলেন, শুধু কৃষক নয়, যেকোনো কৃষি উদ্যোক্তাও এসব যন্ত্র নিতে পারবে। আমার কাছে কেউ লিখিতভাবে অভিযোগ করেনি। অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেবেন বলে জানান তিনি।

খালেদ / পোস্টকার্ড ;