সীতাকুন্ডের ফৌজদারহাট রেলওয়েকলোনিতে গণধর্ষণের পর খুনের ঘটনায় স্বামীসহ গ্রেপ্তার ৩

সীতাকুন্ডের ফৌজদারহাট রেলওয়েকলোনিতে গণধর্ষণের পর খুনের ঘটনায় স্বামীসহ গ্রেপ্তার ৩

সীতাকুন্ড প্রতিনিধি ।।

চলতি বছরের ৬ জানুয়ারি সীতাকুন্ডের ফৌজদারহাট রেলওয়ের পরিত্যক্ত কলোনির এক ডোবা থেকে এক অজ্ঞাত মহিলার লাশ উদ্ধার করে সীতাকুন্ড মডেল থানা পুলিশ। কিন্তু মহিলাটি কে তা যেমন সনাক্ত করা যাচ্ছিল না, তেমনি কোন ক্লুও পাওয়া যাচ্ছিল না। শেষে সীতাকুন্ড থানার পুলিশ ও সিআইডি এ নিয়ে তদন্তে নেমে তথ্য প্রযুক্তির সহায়তায় প্রথমে নিহতের পরিচয় উদঘাটন করতে সক্ষম হয় । উদ্ধারকৃত লাশটি প্রকৃতপক্ষে একজন ডিভোর্সি নারীর। পরিকল্পিতভাবে ঐ কলোনিতে নিয়ে সাবেক স্বামীসহ তিন খুনী গণধর্ষণ শেষে হত্যা করে ঐ নারীকে।

রবিবার সন্ধ্যায় চট্টগ্রামের চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ১৬৪ ধারায় প্রদানকৃত স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্ধীতে এসব তথ্য জানিয়েছে ঐ ঘটনায় জড়িত তিন খুনী। এর আগে গত শনিবার হত্যাকান্ডের প্রধান আসামি মাহমুদুল্লা প্রকাশ মামুনকে ভোলা থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তার কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে গ্রেপ্তার করা হয় ঘটনায় জড়িত অন্য দুই আসামিকেও। আর এর মধ্য দিয়ে অনেকটা ক্লুবিহীন একটি হত্যা রহস্য উন্মোচিত হল।

সীতাকুন্ড থানা সূত্রে জানা যায়, রাংগুনিয়া উপজেলার শিলক নটওয়াইটিলা গ্রামের মো. আমির হামজার মেয়ে রিমা বেগম (২৫) এর সাথে কুমিল্লার  ব্রাহ্মনপাড়া থানার সাহেবাবাদ গ্রামের সাদন মিয়ার ছেলে মো. রাসেল (৩৫) এর বিয়ে হয়েছিলো। দীর্ঘ ৭ বছর সংসার করার পর তাদের বিবাহ বিচ্ছেদ হয়। এ বিচ্ছেদ নিয়ে রিমার উপর ক্ষুব্ধ ছিলো রাসেল। এদিকে রাসেলের সাথে বিচ্ছেদের পর রিমা বায়েজিদ থানাধীন আমিন কলোনির বেলতলায় বসবাস করে একটি গার্মেন্টসে কাজ নেয়। এখানে নুর হোসেন নামক আরেকজনকে বিয়ে করেন তিনি। এই সূত্রে নুর হোসেনের পরিচিত ভোলা সদর থানার ধনিয়া ইউনিয়ন পরিষদের কানাইনগর গ্রামের ইউনুস মাতব্বরের ছেলে মাহমুদুল্লাহ প্রকাশ ভাগনা প্রকাশ মামুন (৩৪) এর সাথে সখ্যতা গড়ে উঠে রিমার। তাদের গভীর সখ্যতার কারণে রীমা গত ঈদে ভোলায় অবস্থিত মামুনের বাড়িতেও বেড়াতে যায়। এদিকে রীমার সাথে বিচ্ছেদ হলেও সাবেক স্বামী রাসেল রীমার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল। সে মামুনের সাথে রীমার বন্ধুত্বের কথা জেনে তাকে টাকাসহ বিভিন্ন নেশাদ্রব্য দেয় এবং রীমাকে এক রাতে তার কাছে নিয়ে আসার জন্য রাজি করায়। এ লক্ষ পূরণ করতে তারা পূর্ব থেকে সীতাকুন্ডের ফৌজদারহাট রেলওয়ের কলোনির একটি পরিত্যক্ত কক্ষকে দেখা করার জন্য বেছে নেয়।

 গত ৫ জানুয়ারী রাতে মামুন কৌশলে রীমাকে ঐ কলোনীতে নিয়ে যায়। সেখানে আগে থেকে অপেক্ষা করছিল তার সাবেক স্বামী রাসেল ও তার বন্ধু নোয়াখালী সদর থানার বুদ্ধিনগর চৌরাস্তা আন্ডারচর গ্রামের মো. রফিকের ছেলে মো. জামাল (৩০)। এখানে রাসেলসহ তিনজনই তাকে জোরপূর্বক ধর্ষণ করে। রীমা তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ করে তাছাড়া এই গণধর্ষণের ঘটনা সে সবাইকে জানাবে এবং তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেবে জানায়। এ নিয়ে রাসেলের সাথে বাকবিতন্ডার এক পর্যায়ে তারা তিনজন রীমাকে হত্যার সিদ্ধান্ত নেয় এবং এক পর্যায়ে রাসেল তাকে মাটিতে শুইয়ে পা চেপে ধরে, মামুন তার মাথা এবং জামাল গলা চেপে ধরে তাকে নির্মমভাবে হত্যা করে লাশটি ডোবায় ফেলে দেয়।

এদিকে পরদিন ৬ জানুয়ারি ডোবাতে একটি অজ্ঞাত লাশের খবর পেয়ে পুলিশ সেটি উদ্ধার করে এ ঘটনায় মামলা (নং ১২তাং ০৬.০১.২০২০ইং) দায়ের করেন। কিন্তু মেয়েটিকে সনাক্ত করতে না পারায় কোন ক্লু পাওয়া যাচ্ছিল না। শেষে সীতাকুন্ড থানার পুলিশ ও সিআইডি এ নিয়ে তদন্তে নেমে তথ্য প্রযুক্তির সহায়তায়  প্রথমে রীমার পরিচয় উদঘাটন করতে সক্ষম হলে সীতাকুন্ড থানার পরিদর্শক (ইন্টিলিজেন্স) সুমন বণিক এ মামলার তদন্ত শুরু করেন। তিনি থানার এডিশনাল এসপি শম্পা রানী সাহা ও ওসি মো. ফিরোজ হোসেন মোল্লা  সার্বক্ষনিক পরামর্শ অনুযায়ী আসামিদের সনাক্ত করতে ব্যাপক পরিশ্রম করেন। রীমার পূর্ব জীবন ও মৃত্যুর আগের অবস্থান জানতে ছদ্মবেশে চট্টগ্রামের আমিন কলোনীতে বারবার অবস্থান করেন।

সেখানে মামুনের সাথে রীমার সর্বশেষ ভালো সম্পর্কের বিষয়ে অবগত হন। পরে তার বিষয়ে তথ্য অনুসন্ধান করে এ ঘটনায় তার জড়িত থাকার বিষয়ে নিশ্চিত হলে তাকে গ্রেপ্তারে গত শুক্রবার ভোলায় অভিযান চালান। সেখান থেকে মামুনকে গ্রেপ্তার করে থানায় এনে জিজ্ঞাসাবাদ ও তার কাছে থাকা বিভিন্ন প্রমাণ উপস্থাপন করলে মামুন ঘটনার কথা স্বীকার করে এ ঘটনায় জড়িত রাসেল ও জামালের তথ্য দিয়ে বিস্তারিত খুলে বলে। গত শনিবার রাতে চট্টগ্রামে অভিযান চালিয়ে তাদেরকেও গ্রেপ্তার করে সুমন বণিক। এরপর গতকাল রবিবার তাদেরকে চট্টগ্রামের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত চট্টগ্রাম ১ এর শহীদুল্লা কায়সারের আদালতে নিয়ে গেলে সেখানে মামুনসহ তিনজনই ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমুলক জবানবন্দি প্রদান করে। তারা জানায় ধর্ষণের কথা ফাঁস করে দেবার ভয় দেখানোয় রীমাকে হত্যা করা হয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সীতাকুন্ড থানার ওসি মো. ফিরোজ হোসেন মোল্লা বলেন, এটি একটি ক্লুলেস দুর্ধর্ষ গণধর্ষণ ও হত্যা মামলা। আমরা বিষয়টি খুবই গুরুত্বের সাথে নিয়েছিলাম বলে সফলতা এসেছে। এ ক্ষেত্রে ওসি (ইন্টিলিজেন্স) সুমন বণিক অনেক পরিশ্রম করে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন বলে জানান তিনি।