উত্তর কাট্টলীর দরিদ্র মানুষ ত্রাণের জন্য রাস্তায়, অন্য ওয়ার্ড থেকে মানুষ জড়ো করার অভিযোগ

উত্তর কাট্টলীর দরিদ্র মানুষ ত্রাণের জন্য রাস্তায়, অন্য ওয়ার্ড থেকে মানুষ জড়ো করার অভিযোগ
উত্তর কাট্টলীর দরিদ্র মানুষ ত্রাণের জন্য রাস্তায়, অন্য ওয়ার্ড থেকে মানুষ জড়ো করার অভিযোগ

নিজস্ব প্রতিবেদক।।

চটগ্রাম নগরীর উত্তর কাট্টলী ইতিহাস ও ঐতিহ্যগতভাবে সমৃদ্ধ একটি এলাকা।  চট্টগ্রামের প্রবেশদ্বার হওয়ায় এই এলাকাটির গুরুত্ব বেড়েছে বহুবিধ।  অপেক্ষাকৃত ধনী এবং চট্টগ্রামসহ পুরো বাংলাদেশের নেতৃত্ব দেয়া অনেক গুণী ব্যক্তিত্বদেরও জন্মস্থান এই উত্তর কাট্টলী।  তবে অতীতেও এই অঞ্চলে দরিদ্র মানুষ ছিল।  কিন্তু কখনোই সেসব দরিদ্র মানুষ পেটের খাবার যোগাতে রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ বা মানববন্ধন করেনি কখনো।  কারণ এই অঞ্চলের যারা বিত্তবান ও সমাজপতি ছিলেন তারা কখনোই এখানকার দরিদ্র মানুষ কষ্ট পাক এমনটি চাইতেন না।  খোঁজ রাখতেন কোন পরিবারে সংকট।  গোপনে তা পাঠাতেন।  ভালো থাকতো দরিদ্র মানুষেরা। কিন্তু এখন অবস্থা ভিন্ন , কেননা এই এলাকায় বহিরাগত রিকশাচালক, টেক্সিচালক, অন্যের বাসায় কাজ করা গৃহকর্মী, নির্মাণ শ্রমিকসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার  মানুষ এখন এই এলাকায় অবস্থান নিচ্ছে । আর সে কারণে পুরোনো ঐতিহ্য ধরে রাখা উচ্চ বিত্তের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না আর তাই আজ খেটে খাওয়া মানুষ মহাসড়কে নেমেছেন ত্রাণের জন্য।

আজ বৃহস্পতিবার সকাল ১০ টার দিকে প্রায় হাজার খানেক দিনমজুর, রিকশাচালক, টেক্সিচালক, অন্যের বাসায় কাজ করা গৃহকর্মী, নির্মাণ শ্রমিকসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার দরিদ্র মানুষেরা রাস্তায় দাঁড়িয়ে ক্ষোভ জানিয়েছেন।  প্রয়োজনে তারা এমপি-কাউন্সিলরের বাড়িতে যাবেন বলে জানিয়েছেন।  এসময় বিক্ষোভকারীদের ঘরে ফিরতে আকবরশাহ থানা পুলিশ বার বার তাদের আহ্বান জানায়।  তাদের বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে- পুলিশের এমন আহ্বানে ১ ঘন্টা পর তারা মানববন্ধন স্থগিত করে ফিরে যান।

অন্যদিকে ত্রাণের জন্য মানববন্ধন করা নারী-পুুরুষদের অন্য ওয়ার্ড থেকে আনা হয়েছে দাবি করে ওয়ার্ড কাউন্সিলর ড. নিছার উদ্দিন আহমেদ মঞ্জু বলেছেন, বিএনপি-জামায়াতের সাথে মিলে এলাকার কিছু নামধারী আ’লীগের নেতা-কর্মীরা সরকারকে সমালোচনায় ফেলতে এমন কাজ করছে।  এ জন্য তিনি সবাইকে সতর্ক করে বলেছেন- পর্যায়ক্রমে সবাই ত্রাণ পাবেন।  সরকার থেকে আমরা যা পাচ্ছি তাই বিতরণ করছি।

আর স্থানীয় সংসদ সদস্য দিদারুল আলম বলেছেন, দল-মতের উর্ধ্বে উঠে ত্রাণ বিতরণের কথা।বিশ্বজুড়ে মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়া করোনা ভাইরাসের সংকটময় মুহুর্তে যখন পুরো দেশ লকডাউনে, তখন দিন এনে দিনের চাহিদা মেটানো দরিদ্র মানুষগুলোর কাজকর্ম বন্ধ।  সরকার থেকেও আশ্বস্থ করা হয়েছে যারা দিন মজুর, শ্রমিক কিংবা নিম্নবিত্ত পরিবার, তারা কোনো খাদ্য কষ্টে থাকবেন না।  সরকারের পর্যাপ্ত খাদ্য মজুদ আছে।  আপনারা ঘর থেকে বের হবেন না।  আমরা ঘরে ঘরে উপহার সামগ্রী পৌঁছে দিব যাতে আপনার খাবারের কষ্টে না ভোগেন।  কিন্তু এসবকে মিথ্যা প্রমাণিত করে ইতোমধ্যে ত্রাণ সহায়তার জন্য দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ এমনকি সরকারি ত্রাণবাহী গাড়ি থেকে ত্রাণ কেড়ে নেয়ারও ঘটনা ঘটেছে।

কিন্তু বাস্তবতা একেবারেই ভিন্ন।  সরকার থেকে খাদ্যসামগ্রী বিশেষত চাউল, ডাল, শিশু খাদ্য যে পরিমাণ পাঠানোর কথা তার চেয়ে অনেক কম দেয়া হচ্ছে।  আবার যারা একবার পেয়েছেন তারা বিভিন্নভাবে একাধিকবার ত্রাণ সহায়তা পেয়েছেন শুধুমাত্র স্থানীয় জনপ্রতিনিধির সমর্থক হওয়ার সুবাধে।  কিন্তু এমন অসংখ্য পরিবার রয়েছে যারা একবারও ত্রাণ সামগ্রী পাননি।  সরকারের কিংবা ব্যক্তি উদ্যোগে কারো কাছ থেকে কোনো ধরণের খাদ্য সহায়তা না পেয়ে তারা রাস্তায় নামতে বাধ্য হন বলে জানা গেছে।

কিছুদিন আগেও অন্যের বাসায় কাজ করতো নিউ মনছুরাবাদের শানু আকতার।  করোনার কারণে সেই বাড়িতে তাকে আর যেতে বারণ করা হয়।  ফলে গত ১ মাস ধরে তিনি বেকার।  এখন পর্যন্ত মোট ৩ কেজি চাউল, আধা কেজি ডাল, আধা লিটার তেল, এক কেজি পেঁয়াজ ও আলু পেয়েছেন।  কিন্তু ঘরে কোনো ইনকাম নেই।  তার দুই মেয়ে- স্বামী নেই।  শানু বলেন, আমরা হুনি সরকার ঘরে ঘরে খাবার পৌঁছাইয়া দিবো। কিন্তু গত এক মাসেও কোনো খাবার বা আমার ঘরে কোনো ত্রাণ কেউ দেয় নাই।  গত ২৯ তারিখ এক গার্মেন্টস মালিক আমাগো কয়েকজনরে ৩ কেজি চাউল, ১ কেজি কইরা আলু, পেঁয়াজ, আধা কেজি তেল ও অন্যাইন্য কিছু সামগ্রী দিছে।  এহন কন আমরা তিনজনের পরিবার এই পরিমাণ দিয়া কয়দিন যায়?  হুনছি সরকার ত্রাণ দিতাছে।  কিন্তু আমরা কেউই সরকারি ত্রাণ পাই নাই এখনো।  কাউন্সিলরের লোক ছাড়া কাউরে ত্রাণ দেয় না। কে আমরা কি ভোট দেই না।  আমরা কি মানুষ না?

উত্তর কাট্টলর নিউ মনছুরাবাদ রেললাইনস্থ বস্তিতে থাকেন আয়শা খাতুন।  তিনি জানান, আমি ভাঙারি কুড়াই।  এখন আর করা যায় না।  ভাঙারির দোকানও বন্ধ।  গত ১ মাস ধরে তিনি খুব কষ্টে থাকলেও কেউ তাদের সহায়তা দিতে যায়নি।  লোকমুখে শুনেছেন সরকার ত্রাণ পাঠিয়েছে।  কিন্তু সেই ত্রাণ যারা পাচ্ছেন তারা আরো দুইমাস লকডাউন থাকলেও চলতে পারবে- এমন মানুষদের দেয়া হচ্ছে।

কিছুদিন আগে সিকিউরিটি গার্ডের কাজ করতেন উত্তর কাট্টলীর নিউ মনছুরাবাদ এলাকার মো. শাহজাহান আলী। তিনি বলেন, করোনার কারণে চাকুরিটা গেছে। পোলাপান নিয়া কিভাবে দুই বেলা খাইতাছি আল্লাহ-ই জানেন। হুনতাছি সরকারে ত্রাণ দিছে কয়েকবার।  কিন্তু আমরা এতোগুলা মানুষ একবারও পাইলাম না এইসব।  কিন্তু আমি দেখছি এমন লোকও ত্রাণ পাইছে যে পাঁচমাস চাকুরি না করলেও বইসা বইসা খাইতে পারবো।

তার মতোই ভাঙারি কুড়ানো নুর বেগম, গার্মেন্টস কর্মী রিনা আকতার ও সুমী আকতার, গৃহকর্মী শাহিন বেগম, দিনমজুর মো. জাহাঙ্গীর আলম মোল্লা, মো. কামাল, রিকশাচালক নুরুল আমীনসহ প্রায় হাজারখানেক দরিদ্র মানুষ উত্তর কাট্টলীর কর্নেলহাটস্থ ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে মানববন্ধন করে ত্রাণ দেয়ার দাবি জানান।  তাদের দাবি- কাউন্সিলর ও তার প্রতিনিধিরা তাদের পরিচিত লোকদেরই সরকারি খাদ্য সহায়তা দিচ্ছে।  এমন ব্যক্তিকেও দেয়া হচ্ছে যিনি ত্রাণ না নিলেও চলতে পারবেন। আবার এমনও মানুষ আছেন যিনি অন্তত ৪ বার বিভিন্নভাবে ত্রাণ সহায়তা পেয়েছেন।

কাউন্সিলরের পক্ষে নিউ মনছুরাবাদ এলাকায় সরকারি ত্রাণ বিতরণের দায়িত্ব পাওয়া নগর যুবলীগ নেতা আবুল কালাম আবু জানান, আমি এই পর্যন্ত দুই দফায় কাউন্সিলরের কাছ থেকে শুধুমাত্র ১২৫ পরিবারের জন্য ১২৫ প্যাকেট ত্রাণ পেয়েছি যা বিতরণ করেছি।  আমাদের এখানে চাহিদা বেশি থাকলেও সরকার থেকে না পেলে আমরা কিভাবে দেবো?  তিনি বলেন, আমি ব্যক্তিগতভাবেও ত্রাণ দিয়েছি।  সামনে আর এই দায়িত্ব নেবো না।  পারলে নিজে দেবো।  তাও এই অল্পসংখ্যক ত্রাণ দিতে গিয়ে সমালোচনার মুখে পড়তে চাই না।

স্থানীয় একাধিক অধিবাসী জানান, এখানে আওয়ামী লীগ নেতারাই গ্রুপিং এ জড়িত। যে কারণে কাউন্সিলর শুধু তার অনুসারিদেরই সরকারি ও বেসরকারি সকল ত্রাণ দিচ্ছেন- এমন অভিযোগ এনে বিপক্ষ গ্রুপ অন্যদের ক্ষ্যাপিয়ে তুলছেন। এখানে একগ্রুপ করেন প্রয়াত এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী গ্রুপ, অন্যরা করেন আ জ ম নাছির গ্রুপ। কিন্তু সরকারি ত্রাণগুলো নগরে যাচ্ছে সিটি কর্পোরেশনের মাধ্যমে। স্বভাবতই এসব নাছিরপন্থী কাউন্সিলর নিছার উদ্দিন আহমেদ মঞ্জু তার সমর্থক ও সহযোগিদেরই দিচ্ছেন। এজন্য এই অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। আর এমন কাউকে কাউকে দেয়া হচ্ছে যারা ত্রাণ পাওয়ারই যোগ্য না। আবার অনেকেই আছে যারা কয়েকবার ত্রাণ পেলেও অনেকে একবারও এসব ত্রাণ পায়নি। আবার যে পরিমাণ বরাদ্দ আসছে তা দিয়ে হচ্ছে না। কেউ পাচ্ছে, কেউ পাচ্ছে না। এ জন্যই এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে।

এদিকে এক ভিডিও বার্তায় স্থানীয় কাউন্সিলর ড. নিছার উদ্দিন আহমেদ মঞ্জু বলেছেন, কেউ যদি ত্রাণ না পান, বা কারো ত্রাণের প্রয়োজন তাহলে আমার সাথে সরাসরি যোগাযোগ করতে পারেন।  পরে থেকে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার ওয়ার্ডে সর্বশেষ মোট ৩৬৪টি পরিবারের জন্য ৩৬৪টি ত্রাণ সহায়তার প্যাকেট এসেছে।  আমি সেখান থেকে ১০০ প্যাকেট নিউ মনছুরাবাদ, ১০০ প্যাকেট বিশ্বাসপাড়া, ১০০ প্যাকেট মুন্সিপাড়া এবং ৬৪ প্যাকেট কয়েকটি পরিবারকে জরুরিবিবেচনায় বিতরণ করেছি।  এসবই আমাদের সংসদ সদস্য, দলীয় নেতৃবৃন্দের সাথে সমন্বয় করে করা হচ্ছে।  যে পরিমাণ ত্রাণ পাঠানো হচ্ছে তা দিয়ে তো আমি সবাইকে সন্তুষ্ট করতে পারবো না।  পর্যায়ক্রমে সরকার সিটি কর্পোরেশনের মাধ্যমে যা পাঠাচ্ছে এবং পাঠাবে তা বিতরণ করা হবে।  আগেও যা বিতরণ করা হয়েছে তার পূর্ণাঙ্গ তথ্য, ত্রাণ পাওয়ার আইডি কার্ডের কপি আমরা সংরক্ষণ করছি।  সুতরাং এগুলো নিয়ে যারা ধুম্রজাল সৃষ্টি করছে তারা অবশ্যই সরকার বিরোধী গোষ্ঠী। প্রশাসন এসব বিষয়ে চোখ রাখছে।

চট্টগ্রাম- ৪ আসনের সংসদ সদস্য ও উত্তর কাট্টলীর বাসিন্দা আলহাজ্ব মো. দিদারুল আলম জানান, আসলে সরকারি বরাদ্দটা খুবই অপ্রতুল। পুরো নগরের ৪১ ওয়ার্ডে বরাদ্দ যেটা দেয়া হচ্ছে সেটা ওয়ার্ডভিত্তিক ভাগ করলে ১০০/১২০ পরিবার পায়। কিন্তু আপনি দেখেন আমার নির্বাচনী এলাকা উত্তর কাট্টলী থেকেও উত্তর পাহাড়তলী ওয়ার্ডে নগরের অন্যতম বেশি সংখ্যক মানুষের বসবাস যারা খুবই নিম্নবিত্ত। যাই হোক, আমি আমার এলাকায় সহায়তার পরিমাণ বাড়ানোর জন্য ইতোমধ্যে আবেদন করেছি। এছাড়াও আমার পরিবারের পক্ষ থেকে শুধু কাট্টলীতেই ১ হাজার পরিবারকে সহায়তা দেয়া হয়েছে। এছাড়াও আমি ব্যক্তিগতভাবে আমার নির্বাচনী এলাকার ওয়ার্ড, থানা ও ইউনিট নেতৃবৃন্দের মাধ্যমে আমি সহায়তা পাঠাচ্ছি। এখন যে পরিস্থিতি, এটার জন্য আসলে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। আর আমার কাছে যে অভিযোগ আসছে যে, মুখ দেখে কিংবা দলীয় বিবেচনায় কিংবা অনুসারিদের মধ্যেই ত্রাণ দেয়া হচ্ছে। আমি আমাদের নেতৃবৃন্দকে অনুরোধ করবো যেন তারা এই ধরণের মনমানসিকতা না দেখান। দল-মতের উপরে উঠে যেন সব ধরণের সহায়তা তারা দেন।