চট্টগ্রাম শিশুকন্যাদের জন্য অনিরাপদ, পাঁচ মাসে খুন চার শিশুকন্যা এখনও নিখোঁজ ১

চট্টগ্রাম শিশুকন্যাদের জন্য অনিরাপদ, পাঁচ মাসে খুন চার শিশুকন্যা এখনও নিখোঁজ ১
চট্টগ্রাম শিশুকন্যাদের জন্য অনিরাপদ, পাঁচ মাসে খুন চার শিশুকন্যা এখনও নিখোঁজ ১

বিশেষ প্রতিবেদক ।। 

চট্টগ্রাম শিশুকন্যাদের জন্য অনিরাপদ হয়ে উঠছে । গত বছর ১৮ সেপ্টেম্বর থেকে ২১ মার্চ পর্যন্ত পাঁচ মাসে চট্টগ্রামে খুন হয়েছে চার শিশুকন্যা। এই সময়ে আরও দুই শিশুকন্যাকে জীবিত উদ্ধার করতে সক্ষম হলেও এখনও নিখোঁজ রয়েছে এক শিশুকন্যা। এ নিয়ে অস্থির হয়ে পড়েছে পুলিশ প্রশাসন।

প্রশাসনের মতে, অবোধ শিশুকন্যাদের জন্য দিন দিন অনিরাপদ হয়ে উঠছে চট্টগ্রাম।

সিএমপির গোয়েন্দা শাখার উপ-পুলিশ কমিশনার মুহাম্মদ আলী হোসেন এ প্রসঙ্গে বলেন, চট্টগ্রাম মহানগরে পুলিশি তৎপরতায় খুন, ছিনতাই-ডাকাতির মতো অপরাধ কমলেও সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কয়েকটি শিশু নিগ্রহ ও নিখোঁজের ঘটনায় পুলিশ প্রশাসনে অস্বস্তি বিরাজ করছে।

তিনি বলেন, সম্প্রতি তিন শিশুকন্যাকে ধর্ষণের পর হত্যা, এক শিশুকন্যাকে অপহরণের পর হত্যার ঘটনায় খুনিদের শনাক্ত করে পুলিশ গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারে উদ্ধার করা হয়েছে নিখোঁজ দুই শিশুকন্যাকেও। তবে এক শিশুকন্যার হদিস মিলেনি এখনও।

ধর্ষণের পর খুনের শিকার যেসব শিশুকন্যা :

চট্টগ্রামে ধর্ষণের পর হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে ১০ বছরের শিশু আবিদা সুলতানা আয়নী। এটিই এ পর্যন্ত সর্বশেষ ঘটনা। গত ২৯ মার্চ ভোরে নগরীর পাহাড়তলী থানার আলমতারা পুকুরপাড়া মুরগিফার্ম এলাকার ডোবা থেকে শিশু আয়নীর বস্তাবন্দি লাশ উদ্ধার করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।

পিবিআই চট্টগ্রাম মেট্রো ইউনিটের পুলিশ সুপার নাইমা সুলতানা এ তথ্য নিশ্চিত করে বলেন, গত ২১ মার্চ নিখোঁজ হয় শিশু আয়নী। আয়নী নগরীর পাহাড়তলী কাজীরদীঘি সাগরিকার একটি বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী ছিল। এ ঘটনায় মোহাম্মদ রুবেল নামে স্থানীয় এক তরকারি বিক্রেতাকে আটক করা হয়।

জিজ্ঞাসাবাদে তার দেওয়া তথ্যমতে পুলিশ আয়নীর লাশ উদ্ধার করে। পুলিশকে দেওয়া তথ্যে রুবেল জানায়, ধর্ষণের পর আয়নীকে গলাটিপে হত্যা করে বস্তাবন্দি লাশ ডোবায় ফেলে দেওয়া হয়। ২১ মার্চ স্কুলে যাওয়ার পথে বিড়ালছানা দেওয়ার লোভ দেখিয়ে আয়নীকে অপহরণ করা হয় বলে জানায় রুবেল। এই ঘটনা পুলিশ প্রশাসনসহ চট্টগ্রামের সচেতন মহলকে নাড়া দিয়েছে বলে জানান পিবিআই পুলিশ সুপার।

এর আগে গত বছর ১৫ নভেম্বর বিকালে বাড়ির পাশের মক্তবে পড়তে গিয়ে নিখোঁজ হয় চট্টগ্রাম মহানগরীর ইপিজেড থানার দক্ষিণ হালিশহর ওয়ার্ডের নয়ারহাট এলাকার বাসিন্দা সোহেল রানার ছয় বছর বয়সি কন্যা আলীনা ইসলাম আয়াত। এ ঘটনার ১০ দিনের মাথায় পিবিআই তাদের বাড়ির ভাড়াটিয়া আজহারুলের ছেলে আবির আলীকে গ্রেফতারের মধ্য দিয়ে এই নিখোঁজ রহস্য উদঘাটন করে। এরপর আবির আলীর দেওয়া তথ্য মোতাবেক আয়াতের লাশের খণ্ড খণ্ড অংশ উদ্ধার করে পিবিআই। আবির আলী বর্তমানে কারাগারে রয়েছে।

এর আগে গত বছর ২৭ অক্টোবর বিকালে নগরীর জামালখান সিকদার হোটেলের পাশে ব্রিজ গলির বড় নালা থেকে মারজান হক বর্ষা (৭) নামে এক শিশুর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ঘটনার তিন দিন আগে বিকালে ওই এলাকায় নিজেদের ভাড়া বাসা থেকে বিস্কুট কিনতে বের হওয়ার পর সে নিখোঁজ হয়। তার বাবা আবদুল হক মৃত। মা ঝর্ণা বেগম ও সৎবাবা মোহাম্মদ ইউছুফের সঙ্গে ব্রিজ গলির বাসায় থাকত বর্ষা।

লাশ উদ্ধারের পর তার মা বাদী হয়ে কোতোয়ালি থানায় হত্যা মামলা করেন। পুলিশ লাশ উদ্ধারের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই স্থানীয় মুদির দোকান শ্যামল স্টোরের কর্মচারী লক্ষণ দাশকে (৩০) গ্রেফতার করে। জিজ্ঞাসাবাদে লক্ষ্মণ দাশ জানায়, ১০০ টাকা দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে চিপস কিনতে যাওয়া শিশু বর্ষাকে গুদামে নিয়ে ধর্ষণের পর শ্বাসরোধে হত্যা করে লাশ বস্তায় ভরে পাশের বড় নালায় ফেলে দেয়। গ্রেফতারের পরদিন ধর্ষণ ও হত্যার দায় স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দেওয়ার পর আসামি লক্ষণকে কারাগারে পাঠানো হয়।

এর আগে একই বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর বন্দর থানার পোর্টকলোনি এলাকার একটি পরিত্যক্ত বাসা থেকে সাত বছর বয়সি সুরমা আকতারের লাশ উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় জড়িত নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ থানার হাজিপুরে সিরাজ সর্দার বাড়ির আলী আজমের ছেলে ওসমান ফারুক মিন্টুকে পুলিশ গ্রেফতার করে।

এখনও নিখোঁজ এক কন্যাশিশু :

চট্টগ্রামে এবার চার দিন ধরে নিখোঁজ রয়েছে জান্নাতুল ফেরদৌস মাইশা নামে ১০ বছরের এক শিশুকন্যা। গত ৩১ মার্চ রাতে হালিশহর থানার ওসি জহির উদ্দিন জানান, গত ২৮ মার্চ থেকে শিশুকন্যাটি নিখোঁজ রয়েছে। শিশু মাইশা নগরীর হালিশহর থানার মাদাইয্যাপাড়া এলাকার মো. আলমগীরের মেয়ে বলে জানান তিনি।

ওসি বলেন, শিশুকন্যাটির বাবা জানিয়েছেন গত ২৮ মার্চ পড়ালেখার জন্য বকাবকি করলে শিশুটি সন্ধ্যা ৭টার দিকে ঘর থেকে পরিবারের লোকজনের অজান্তে বের হয়ে যায়। এরপর থেকে আর বাড়ি ফেরেনি। ২৯ মার্চ হালিশহর থানায় শিশুটি নিখোঁজের ঘটনায় সাধারণ ডায়েরি করা হয়েছে। ইতিমধ্যে বেশ কিছু সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে। তার সন্ধানে এলাকায় মাইকিং করা হয়েছে। এলাকায় শিশুটির সন্ধান চেয়ে পোস্টার সাঁটানো হয়েছে। আমরা শিশুটিকে দ্রুত তার পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছি।

অপহৃত দুই কন্যাশিশুকে জীবিত উদ্ধার :

সিএমপির তথ্যমতে, গত ৫ মাসে চট্টগ্রামে অপহৃত দুই শিশুকন্যাকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে বন্দর থানার কলসিদীঘির পাড় এলাকা থেকে অপহৃত তিন বছরের শিশু জেমিকে ফেনী সদর থানা এলাকা থেকে উদ্ধার করা হয় গত বছর ২২ নভেম্বর। এ ঘটনায় গ্রেফতার করা হয় অপহরণকারী মো. জয়নাল আবেদিনকে।

সিএমপির উপ-পুলিশ কমিশনার (বন্দর) শাকিলা সুলতানা বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে অপহরণকারী জয়নাল কৌশলে জেমিকে নিয়ে ফেনী চলে যাওয়ার কথা স্বীকার করে। ২২ সেপ্টেম্বর নানির কোল থেকে অপহৃত হয় জেমি। ওইদিন লাকসাম থেকে ট্রেনে চড়ে চট্টগ্রাম আসছিলেন জেমি ও তার নানি।

এর আগে গত বছর ১০ নভেম্বর চট্টগ্রাম মহানগরের বাকলিয়ার কল্পলোক আবাসিক এলাকা থেকে অপহৃত শিশু আসমাউল হুসনাকে উদ্ধার করে পুলিশ। তাদের বাসার সাবলেট থাকা নাফিজা আক্তার সুমি তাকে অপহরণ করে কক্সবাজার নিয়ে গিয়েছিল।

বাকলিয়া থানার ওসি আবদুর রহিম বলেন, গত বছর ৭ নভেম্বর সকালে পাঁচ মাস বয়সি শিশু আসমাউল হুসনাকে বাসায় সাবলেট থাকা সুমির কোলে দিয়ে গোসল করতে যান মা তাসলিমা আক্তার। সেখান থেকে তিনি এসে দেখেন তার মেয়ে নাফিজা আক্তার সুমি নেই। থানায় মামলা করার পর তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে নাফিজা আক্তার সুমিকে গ্রেফতার ও শিশুটিকে উদ্ধার করা হয়।

এভাবে একের পর এক নিষ্পাপ শিশুকন্যাদের প্রতি এমন পৈশাচিকতায় চট্টগ্রামের জনমনে উদ্বেগ ও ভীতির সঞ্চার করেছে বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রাম জেলা জজ আদালতের অ্যাডভোকেট আখতার কবির চৌধুরী।

তিনি বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে সংঘটিত শিশুকন্যা নিগ্রহ ও হত্যাকাণ্ডের শিকারের ঘটনাগুলো আঁতকে ওঠার মতো। একটা সমাজের কতটা অধঃপতন হলে এ ধরনের কর্মকাণ্ড ঘটে। যারা এসব ঘটনায় জড়িত তাদের চোখ যতদিন উপড়ে ফেলতে না পারবেন ততদিন এসব কর্মকাণ্ড চলবে। সে জন্য প্রশাসনকে কঠোর ভূমিকা নিতে হবে। সঙ্গে আমাদের চারপাশের এসব হায়েনাকে দেখে রাখতে হবে। তবেই আমাদের কোমল শিশুকন্যাগুলোর জন্য নিরাপদ স্বাধীন পরিবেশ তৈরি হবে।

খালেদ / পোস্টকার্ড ;