চট্টগ্রাম সহসা জলাবদ্ধতার কবল থেকে মুক্তি পাচ্ছে না

চট্টগ্রাম সহসা জলাবদ্ধতার কবল থেকে মুক্তি পাচ্ছে না

জসীম চৌধুরী সবুজ।। 

চট্টগ্রামবাসীর কপালের দুঃখ ঘুচছে না। জলাবদ্ধতার কবল থেকে সহসা মুক্ত হচ্ছে না চট্টগ্রাম। চট্টগ্রাম মহানগরীকে জলাবদ্ধতার ভয়াবহ অভিশাপ থেকে মুক্তি দিতে গ্রহণ করা হয়েছিল সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প। তিন বছরমেয়াদি এ প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা জুন ২০২০-এর মধ্যে। কিন্তু এখনও শুরুই করা যায়নি খাল খননসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ। শেষ হয়ে গেছে মেয়াদও। এ অবস্থায় প্রকল্প মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে আরও দু’বছর, ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত। অর্থাৎ চট্টগ্রামবাসী জলাবদ্ধতার থেকে সহসা মুক্ত হচ্ছে না।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা নিরসনে প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয় ২০১৭ সালে। এটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়া হয় চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে (সিডিএ)। মোট ৫ হাজার ৬১৬ কোটি টাকার এই প্রকল্পের অধীনে নির্ধারিত কাজ হচ্ছে কর্ণফুলী নদীর সঙ্গে সংযুক্ত ১৬টি খাল। এসব খালের সঙ্গে সংযুক্ত আরও ৩৬টি খাল পরিকল্পিত পুনঃখনন, সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন। খালের প্রশস্ততা রক্ষার জন্য গুরুত্বপূর্ণ খালগুলোর পাড় ঘেঁষে ৮৫ দশমিক ৬৮ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ, যা খাল পরিষ্কারে ভ‚মিকা রাখা ছাড়াও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে ভ‚মিকা রাখবে। পানিপ্রবাহ স্বাভাবিক রাখতে ৪৮টি পিসি গার্ডার ব্রিজ ও ছয়টি কালভার্ট নির্মাণ। এই প্রকল্প কাজ শুরু হলে বিভিন্ন জায়গায় রাস্তাঘাট বন্ধ বা সঙ্কুচিত হয়ে যায়। চমেক হাসপাতালের সামনে একটি কালভার্ট নির্মাণকাজ সোয়া দু’বছর আগে শুরু হলেও এখনও শেষ হয়নি। গুরুত্বপূর্ণ এই জায়গায় বছরের পর বছর সড়ক বন্ধ থাকায় রোগীসহ সাধারণ মানুষকে পোহাতে হচ্ছে সীমাহীন দুর্ভোগ। চট্টগ্রাম ওয়াসার পাইপলাইন সময়মতো না সরানোয় এই দুর্ভোগ বলে জানান প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা।

প্রকল্পের মূল কাজ খাল খনন। সে কাজে এখনও হাতই দেওয়া হয়নি। সিডিএ শুধু বলে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব সেনাবাহিনীকে দেওয়া হয়েছে। তারাই বলতে পারবে দেরির কারণ। সংশ্লিষ্ট সেনা কর্মকর্তা জানান, খাল খনন শুরুর আগে রাস্তা ও রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণের জন্য যে ভুমি অধিগ্রহণ করার কথা তাই-ই এখনও করা হয়নি। যে কারণে খাল খননের মূল কাজে হাত দেওয়া যাচ্ছে না।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, চিহ্নিত খালগুলোয় যেসব অবৈধ দখলদারকে উচ্ছেদ করা হয়েছিল কাজ শুরু না হওয়ায় তা আবার বেদখল হয়ে যাচ্ছে। অধিকাংশ খাল ময়লা-আবর্জনা ও বর্জ্যে ভরাট হয়ে যাওয়ায় বৃষ্টির পানি প্রবাহিত হতে পারছে না। ফলে সামান্য বৃষ্টি হলেই নগরী কোমর বা হাঁটু পানির নিচে তলিয়ে যাচ্ছে।

সিডিএ মেগা প্রকল্পটির কাজ শুরু করে অনেকটা ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দেওয়ার মতো করে। ২০১৭ সালে সিডিএ চেয়ারম্যান ছিলেন মহানগর আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ আবদুচ ছালাম। প্রকল্পের পরামর্শক ডিজাইন দেওয়ার আগেই কাজ শুরু করতে গিয়ে তৈরি হয় জটিলতা। সিডিএতে এ কাজে অভিজ্ঞ লোকজনও নেই। তাই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন ও তদারকির দায়িত্ব দেওয়া হয় সেনাবাহিনীর হাতে।

২০১৮ সালের ২০ এপ্রিল সেনাবাহিনীর সঙ্গে সিডিএ’র চুক্তি (এমওইউ) স্বাক্ষরিত হয়। এরপর নিয়োগ দেওয়া হয় ১৫টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে। কিন্তু ডিজাইন এবং জমি বুঝিয়ে দিতে না পারায় অনেক প্রতিষ্ঠান কাজই শুরু করতে পারেনি। কয়েকটি খালে রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণের কাজ চলছে। আবার অনেক খালে রিটেইনিং ওয়াল করতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে সেখানে পাইলিং করতে হবে, যা মূল ডিজাইনে নেই। এমনসব জটিলতায় প্রকল্পের মূল কাজে হাতই দেওয়া গেল না। অথচ তিন বছর মেয়াদ শেষ হয়ে গেল। এখন আবার দু’বছর মেয়াদ বাড়ানো হলেও নগরবাসীর দুঃখ কখন ঘুচবে, কখন জলাবদ্ধতার কবল থেকে মুক্তি পাবে চট্টগ্রামবাসী সেজন্য গুনতে হবে অপেক্ষার প্রহর।

প্রকল্প পরিচালক সিডিএ’র নির্বাহী প্রকৌশলী আহমেদ মঈনুদ্দীন জানান, প্রকল্প কাজের অগ্রগতি হয়েছে ৪০ শতাংশের মতো। গত জুনে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। সেজন্য আরও দুবছর সময় বাড়ানো হয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের ও তদারকির দায়িত্ব সেনাবাহিনীকে দেওয়া হয়েছে। তারাই ভালো বলতে পারবে এ ব্যাপারে।

প্রকল্প বাস্তবায়নে সেনাবাহিনীর দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা লে. কর্নেল শাহ আলী মঙ্গলবার সময়ের আলোকে জানান, সার্বিকভাবে প্রকল্প কাজের ৫০ শতাংশ অগ্রগতি হয়েছে। মূল কাজ খাল খনন শুরু করতে না পারার পেছনে সমস্যা হচ্ছে ভুমি অধিগ্রহণ কাজ সম্পন্ন না হওয়া। কাজটি করবে সিডিএ। খালের পাড়ে রাস্তা ও রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণের জন্য যে ভুমি অধিগ্রহণ করতে হবে তা শেষ করে সিডিএ এখনও আমাদের বুঝিয়ে দেয়নি। এটা হলে কাজেও গতি আসবে। এ ছাড়া যেসব কাজে এ ধরনের প্রতিবন্ধকতা নেই সেখানে কাজ চলছে। খাল পাড়ে অনেক অবৈধ দখলদার ছিল। তাদের উচ্ছেদ করা হয়েছে। অনেক খাল পরিষ্কার করা হয়েছে। বিভিন্ন সংস্থার ইউটিলিটি সার্ভিস লাইনের কারণে কালভার্টগুলোর কাজে বিলম্ব হচ্ছে। চমেকের সামনের কালভার্ট নির্মাণে দীর্ঘ সময় লাগায় দুর্ভোগের কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, ওয়াসার পাইপলাইন সরাতে দেরি হওয়ায় এটি হয়েছে। এখন আর সমস্যা নেই। দ্রুত কাজ শেষ হবে। তখন সড়ক খুলে দেওয়া হবে। এই কালভার্টের মূল কাজ শেষ হওয়ায় এবার সেখানে জলাবদ্ধতা হয়নি বলে দাবি করেন তিনি। করোনা পরিস্থিতির কারণে প্রকল্প কাজে কিছু বিঘ্ন সৃষ্টি হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, তা না হলে ৭০ শতাংশ কাজ শেষ করা যেত।

লেখক. ব্যুরো প্রধান, দৈনিক সময়ের আলো, চট্টগ্রাম।