জনবল সংকটে ফায়ার সার্ভিস, সীতাকুণ্ডে ১০ ফায়ার ফাইটারকে পদায়ন

জনবল সংকটে ফায়ার সার্ভিস, সীতাকুণ্ডে ১০ ফায়ার ফাইটারকে পদায়ন
জনবল সংকটে ফায়ার সার্ভিস, সীতাকুণ্ডে ১০ ফায়ার ফাইটারকে পদায়ন

পোস্টকার্ড ডেস্ক ।।

সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোতে বিস্ফোরণ এবং অগ্নিকাণ্ডে যখন অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয় তখন সে আগুন নেভাতে গিয়েছিলেন সীতাকুণ্ড এবং কুমিরা ফায়ার স্টেশনের দমকল কর্মীরা। সেদিনের বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডে এ পর্যন্ত ১০ জন দমকল কর্মীর মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এ সময় আহত হয়েছেন দুটি স্টেশনের আরও ১৬ জন ফায়ার ফাইটার।

ডিপো থেকে উদ্ধার করা যেসব পোড়া লাশ শনাক্ত করা যায়নি, তাদের মধ্যে ফায়ার সার্ভিসের আরও তিনজন রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এছাড়া, আহত হয়ে ফায়ার সার্ভিসের ১৩ জন চিকিৎসাধীন আছেন। মৃত, নিখোঁজ এবং গুরুতর আহত সবাই সীতাকুণ্ড এবং কুমিরা ফায়ার স্টেশনের কর্মী।

সংস্থাটির সিনিয়র স্টাফ অফিসার এবং মিডিয়া সেলের দায়িত্বপ্রাপ্ত মো. শাহজাহান শিকদার জানিয়েছেন, ১৯৮১ সালে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স পূর্ণগঠনের পর থেকে এ পর্যন্ত সব মিলিয়ে ১৭ জন দমকল কর্মী মারা গেছেন। বাংলাদেশে একসাথে এতজন দমকল কর্মীর প্রাণহানি আর কখনোই ঘটেনি।

ফায়ারকর্মীদের আন্তরিকতা, সাহস এবং মানবিক তৎপরতা সমালোচনার ঊর্ধ্বে হলেও জনবল এবং আধুনিক যন্ত্রপাতির অভাবে সংস্থাটির দুর্বলতা তাদের সক্ষমতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরেই জনবল ও সরঞ্জাম সংকটে আছে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর। বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটলে নানা সমস্যার মধ্যে পড়তে হয় অধিদপ্তরকে। আশপাশের উপজেলা ও জেলা থেকে ডেকে আনতে হয়েছে ফায়ার সার্ভিসের ইউনিটকে।

বিএম কনটেইনার ডিপোতে বিস্ফোরণের ঘটনায়ও একই চিত্র দেখা গেছে। শুধু তাই নয়, বিএম ডিপোর আগুন নেভাতে ঢাকা থেকে আনা হয়েছে হাজমত টেন্ডার (গাড়ি), এই ধরনের বিশেষায়িত গাড়ি চট্টগ্রামে নেই। যথাযথ সরঞ্জাম ও প্রশিক্ষণ ঘাটতির কারণে খুব কাছে গিয়ে আগুন নেভাতে গিয়ে সীতাকুণ্ডে হতাহত হয়েছেন ফায়ারকর্মীরা।

সূত্র জানায়, অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি সংকট নিরসনে সম্প্রতি জাম্বু কুশন, লাইট ডিউটি রেসকিউ বোট, ডাইভিং অ্যাপারেটাস, এয়ার কমপ্রেসর মেশিন, রিমোট কনট্রোল ফায়ার ফাইটিং ইউনিট, হেভি ডিউটি লাইট ইউনিট, টোয়িং ভেহিক্যাল, পোর্টেবল পাম্প, বিদ্রিং অ্যাপারেটাস ও স্মোক ইজেক্টরসহ বিভিন্ন যন্ত্রপাতি যুক্ত করা হয়েছে। যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম।

ফায়ার সার্ভিসের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, দেশের জনসংখ্যা বেড়েছে। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে অগ্নিকাণ্ডের সংখ্যাও। কিন্তু সেই অনুযায়ী ফায়ার সার্ভিসের জনবল বাড়েনি। ফায়ার সার্ভিসের অন্তত ৩০ হাজার জনবল প্রয়োজন বলে মনে করেন ফায়ার কর্মকর্তারা। সারা দেশে ফায়ার স্টেশন আছে ৪৮৯টি। কিন্তু সেই হারে বাড়েনি জনবল ও আধুনিক সরঞ্জাম। বর্তমানে ফায়ার সার্ভিসের জনবল আছে ৯ হাজার ৭১৭ জন। যার মধ্যে ফায়ারম্যানের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। সারা দেশে বিভিন্ন ধরনের সরঞ্জাম আছে ৪ হাজার ৩৯৪টি। তার মধ্যে রেসকিউ কমান্ড কার আছে মাত্র ৩টি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফায়ার সার্ভিসের জনবল বাড়ানোর পাশাপাশি সদস্যদের উন্নতমানের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা জরুরী । শুধু সচেতনতা, পরামর্শ ও সুপারিশ দিয়ে অগ্নিদুর্ঘটনা রোধ করা সম্ভব হবে না। তাছাড়া সবাইকে আগাম প্রস্তুতি নিতে হবে। বাণিজ্যিক কিংবা আবাসিক এলাকায় রাসায়নিক, তেজস্ক্রিয় দ্রব্য গুদামজাত করা বন্ধ করতে হবে। আইনকানুন, নিয়মনীতি, ভবন নির্মাণ হচ্ছে কিনা তা তদারকি করতে হবে। উঁচু ভবন করার ক্ষেত্রে ফায়ার সার্ভিসের মাধ্যমে নিয়মিত ব্যবহারকারীদের সচেতন এবং প্রস্তুত করে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে।

ফায়ার সার্ভিস সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা বিভাগে ফায়ার স্টেশন আছে ১১০টি, চট্টগ্রাম বিভাগে ৯৬টি, রাজশাহী বিভাগে ৬৬টি, খুলনা বিভাগে ৫৬টি, বরিশাল বিভাগে ৪১টি, সিলেট বিভাগে ২৯টি, রংপুর বিভাগে ৫৯টি ও ময়মনসিংহ বিভাগে ৩২টি আছে।

এই প্রসঙ্গে ফায়ার সার্ভিসের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, যেভাবে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে তাতে আমরা অনেকটা আতঙ্কিত। কারণ ফায়ার সার্ভিসে প্রয়োজনের তুলনায় সরঞ্জাম অনেক কম। প্রত্যেক সদস্যকে উন্নতমানের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। প্রয়োজনে বিদেশে নিয়ে হলেও প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নিতে হবে। উন্নতমানের প্রশিক্ষণ থাকলে সীতাকুন্ডে ৯ সহকর্মীকে হারাতে হতো না।

এদিকে ওই হতাহতের ঘটনায় দুটি স্টেশন অনেকটা ফায়ার ফাইটারের শূন্যতায় ভুগছিল। আর এ শূন্যতা নিরসনে সীতাকুণ্ড ও কুমিরা ফায়ার সার্ভিস স্টেশনে ১০ জন ফায়ার ফাইটারকে সংযুক্তিতে পদায়ন করা হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উপপরিচালক পূর্ণ চন্দ্র মুৎসুদ্দি।

কুমিরা ফায়ার সার্ভিসের স্টেশন লিডার আতিকুর রহমান জানান, তাঁদের স্টেশনে ৩৯ জন ফায়ার ফাইটার ছিল। ফায়ার ফাইটারদের মধ্যে ১৫ জন ওই দিন আগুন নেভাতে গিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হন। আজ স্টেশনটিতে একজন ওয়্যারহাউস পরিদর্শক ও চারজন ফায়ার ফাইটার দেওয়া হয়েছে।

সীতাকুণ্ড ফায়ার সার্ভিসের জ্যেষ্ঠ স্টেশন কর্মকর্তা মো. নুরুল আলম দুলাল জানান, তাঁদের স্টেশনের ২৪ জনের মধ্যে সেদিন আগুন নেভাতে ছুটে গিয়েছিলেন ১১ জন। বিস্ফোরণে ৩ জনের প্রাণহানিসহ গুরুতরভাবে আহত হন ৮ জন। ফলে ১৩ জন ফায়ার ফাইটার নিয়ে স্টেশন চালাতে হচ্ছে তাঁদের। তবে আজ সংযুক্তিতে পদায়ন পাওয়া ৫ ফায়ার ফাইটার যোগদানের ফলে বর্তমানে স্টেশন ১৫ জন ফায়ার ফাইটার রয়েছে। সহকর্মী হারানোর এই শূন্যতার ভিড়েও তাঁরা সব ধরনের পরিস্থিতি সামাল দিতে প্রস্তুত রয়েছেন বলেও জানান তিনি।

এ বিষয়ে উপপরিচালক পূর্ণ চন্দ্র মুৎসুদ্দি বলেন, চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড একটি শিল্পাঞ্চল বেষ্টিত জনবহুল এলাকা। এ এলাকায় যে কোনো মুহূর্তে অগ্নিকাণ্ডসহ নানা ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। তাই গুরুত্ব বিবেচনা করে সীতাকুণ্ড ও কুমিরা ফায়ার সার্ভিস স্টেশনে বিভিন্ন স্টেশন থেকে ১০ জন ফায়ার ফাইটারকে সংযুক্তিতে পদায়ন করা হয়েছে।

উল্লেখ্য, ৪ জুন সীতাকুণ্ডের বেসরকারি বিএম কন্টেইনার ডিপোতে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এতে ১০ ফায়ার সার্ভিস কর্মীসহ এখন পর্যন্ত ৪৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন অন্তত দুই শতাধিক। চমেক হাসপাতাল, পার্কভিউ, শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউট সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে আহতদের চিকিৎসা চলছে।

খালেদ / পোস্টকার্ড ;