জীবনে যে পরিবর্তন আনে ইতিকাফ, ইতিকাফের প্রস্তুতি নিন এখনই

জীবনে যে পরিবর্তন আনে ইতিকাফ, ইতিকাফের প্রস্তুতি নিন এখনই
জীবনে যে পরিবর্তন আনে ইতিকাফ, ইতিকাফের প্রস্তুতি নিন এখনই

ইসলাম ডেস্ক ।।

ইতিকাফ হচ্ছে দুনিয়ার ঝামেলা ও ব্যস্ততা থেকে মুক্ত হয়ে আল্লাহর ঘরে একান্ত ইবাদতে মনোনিবেশ করা। মুমিনের জীবনে ইতিকাফ যে পরিবর্তন আনে তা জানিয়েছেন যুগে যুগে আল্লাহপ্রেমী বুজুর্গরা। হাফেজ ইবনুল কাইয়্যিম আল জাওযিয়্যাহ (রহ.) ইতিকাফের তাৎপর্য তুলে ধরে বলেছেন, ‘ইতিকাফের উদ্দেশ্য হলো, নিবিড় ঐকান্তিকতায় আল্লাহর প্রতি মন নিবিষ্ট করা, তাঁর স্মরণে নির্জনে বাস করা এবং স্রষ্টার পরম সান্নিধ্য লাভের প্রত্যাশায় সৃষ্টি থেকে দূরে অবস্থান করা, যাতে তার চিন্তা ও ভালোবাসা মনের একান্ত গহিনে স্থান করে নিতে পারে।’ (জাদুল মাআদ : ২/৮২-৮৩)

প্রখ্যাত হাদিসবেত্তা হাফেজ ইবনে রজব হাম্বলী (রহ.) বলেছেন, ‘ইতিকাফের উদ্দেশ্য হলো, সৃষ্টির সঙ্গে সাময়িকভাবে সম্পর্ক ছিন্ন করা এবং স্রষ্টার সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক কায়েম করা। মহামহিম স্রষ্টার সঙ্গে পরিচয় যত দৃঢ় হবে, সম্পর্ক ও ভালোবাসা তত গভীর হবে এবং তা বান্দাকে পুরোপুরি স্রষ্টার কাছে নিয়ে যাবে।’ (লাতাইফুল মাআরিফ: পৃ. ৪০)। আতা আল-খুরাসানি (রহ.) বলেছেন, ‘ইতিকাফকারীর উদাহরণ সে বান্দার মতো, যে নিজেকে আল্লাহর সামনে পেশ করে বলছে- হে আল্লাহ, যতক্ষণ না তুমি ক্ষমা করো, আমি তোমার দরবার ত্যাগ করব না, হে আমার রব, যতক্ষণ না তুমি আমাকে ক্ষমা করো, আমি তোমার দরবার ত্যাগ করব না।’ (শারহু ইবনিল বাত্তাল : ৪/১৮২)

মালিকুল উলামা ইমাম আলাউদ্দীন কাসানী (রহ.) বলেছেন, ‘ইতিকাফ হলো, দুনিয়ার সবকিছু থেকে বিমুখ হয়ে নির্জনে আল্লাহর ঘরে বসে তাঁর নৈকট্য অর্জন করা এবং তাঁর অবারিত রহমত ও ক্ষমা লাভের প্রত্যাশায় একান্তভাবে তাঁর দিকে ধাবিত হওয়া।’ (বাদায়িউস সানায়ে : ২/১০৮)। ইমাম হাসান ইবনে আম্মার আশশুরুমবুলালী (রহ.) বলেছেন, ‘ইতিকাফ যদি একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর জন্য হয় তা হলে তা উত্তমতম ইবাদাত। ইতিকাফের বৈশিষ্ট্য নানাবিধ। ইতিকাফকারী তার অন্তরকে দুনিয়া ও তার বিষয়াদি থেকে মুক্ত করে আল্লাহর নিকট সমর্পণ করে এবং নিজেকে মহাবিশ্বের অধিপতির দরবারে ফেলে রাখে।’ (মারাকিল ফালাহ : ১/২৬৮)

উপমহাদেশের বিখ্যাত আলেম আশরাফ আলী থানবী (রহ.) বলেছেন, ‘ইতিকাফের প্রথমত উদ্দেশ্য হলো শবে কদর তালাশ করা, দ্বিতীয়ত নামাজের জামাতের জন্য অপেক্ষা করা, তৃতীয়ত ইতিকাফের রুহ তথা মৌল উদ্দেশ্য হলো ইতিকাফকারী যেন নিজেকে সর্বহারা, অসহায় ও নিঃস্ব বানিয়ে মহান বাদশাহ আল্লাহর দরবারে নিজেকে পেশ করে এই বলে বলে নিজের সর্বোচ্চ মুখাপেক্ষিতা প্রকাশ করে- ‘হে আল্লাহ এখন আমি আপনার পবিত্র দরবারে পড়ে আছি, চাইলে বের করে দিন, না হয় আমাকে ক্ষমা করে দিন।’ এটা হলো নিজেকে মিটিয়ে দেওয়া।’ (আহকামে ইতিকাফ : ১৬) বর্তমান বিশ্বের সর্বজনশ্রদ্ধেয় খ্যাতনামা আলেমে দ্বীন মুফতি তকী উসমানী বলেছেন, ‘আল্লাহ ইবাদতের যে পদ্ধতিগুলো বলে দিয়েছেন তার মধ্যে কিছু পদ্ধতি একান্তই প্রেমসুলভ। তার মধ্যে ইতিকাফ একটি। ইতিকাফকারী ব্যক্তি পৃথিবীর সামগ্রিক বিষয়াদি থেকে মুক্ত হয়ে আল্লাহর ঘর মসজিদে পড়ে থাকে। নিজেকে আল্লাহর সমীপে সঁপে দেয়। দীর্ঘ একটি সময় পর্যন্ত একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক ও তাঁর দিকে ধাবিত হওয়ার দরুন যে বিশেষ প্রেমের বন্ধন সৃষ্টি হয় তা আসলেই একটি অনন্য ব্যাপার।’ (আহকামে ইতিকাফ : ৬)

ইতিকাফের প্রস্তুতি নিন এখনই

পবিত্র মাহে রমজানের শেষ দশকের দ্বারপ্রান্তে এখন মুসলিম উম্মাহ। এই দশকেই ইতিকাফে আত্মমগ্ন হতে হয় প্রভুর সান্নিধ্য কামনায়। ইতিকাফের নিয়তকারী ব্যক্তি ২০ রমজান আসরের নামাজের পর সূর্যাস্তের আগে মসজিদে পৌঁছাবেন এবং কোণে একটি ঘরের মতো পর্দা দিয়ে ঘেরাও করে অবস্থান নেবেন; এমনভাবে যেন প্রয়োজনে জামাতের সময় পর্দা খুলে মুসল্লিদের জন্য নামাজের ব্যবস্থা করা যায়। এ স্থানে পানাহার ও শয়ন করবেন এবং বিনা প্রয়োজনে এখান থেকে বের হবেন না। আর নারীরা ঘরের নির্দিষ্ট স্থানে, যেখানে তিনি নামাজ আদায় করেন, সেখানেই ইতিকাফ করবেন এবং ঈদের চাঁদ উদয় না হওয়া পর্যন্ত ইতিকাফের স্থান ত্যাগ করবেন না। শাওয়াল বা ঈদের চাঁদ দেখা গেলে ইতিকাফ শেষ হবে।

ইতিকাফের সময় খুব বেশি বাকি নেই। তাই এখন থেকেই ইতিকাফের প্রস্তুতি নেওয়া চাই। প্রতিটি এলাকা থেকে কমপক্ষে একজন বালেগ পুরুষ যেন ইতিকাফে বসেন। একাধিক ব্যক্তি এক মসজিদে ইতিকাফ করতে পারবেন। সবারই মনে মনে ইতিকাফে বসার নিয়ত ও আগ্রহ রাখা কর্তব্য। যিনি ইতিকাফে বসার চূড়ান্ত নিয়ত করবেন তার বিশেষ প্রস্তুতি দরকার। মসজিদে থাকতে যা যা প্রয়োজন আগেভাগেই এর ব্যবস্থা করতে হবে। ইফতার ও সেহরি কে পৌঁছাবে, বাজার করবে কে? ঈদের বাজার, ফেতরা আদায়ের ব্যবস্থা, ছেলেমেয়ের আবদার রক্ষা, কেউ কোনো টাকা-পয়সা পেয়ে থাকলে তা পরিশোধের চেষ্টা করা ও আত্মীয়স্বজনকে ঈদের অগ্রিম দাওয়াত দেওয়াসহ রয়েছে নানা প্রস্তুতি। এগুলো এখনই সারতে হবে। আগেভাগে এসব কাজ সেরে আগ্রহীরা ইতিকাফের জন্য প্রস্তুতি নিন।

ইতিকাফ অবশ্য পালনীয় কোনো ইবাদত না হলেও প্রাপ্তির দিক বিবেচনায় এর গুরুত্ব অপরিসীম। ইতিকাফ আদায়ের মাধ্যমেই লাইলাতুল কদর নসিবের আশা করা যায়। এ জন্যই এ আমলটির ফজিলত ও তাৎপর্য এত বেশি। ইতিকাফ ও ইতিকাফ সংক্রান্ত বিধিনিষেধ পবিত্র কোরআনে এসেছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘আর তোমরা যখন ইতিকাফ করবে তখন স্ত্রীদের সঙ্গে সহবাস করো না। এগুলো আল্লাহর বেঁধে দেওয়া সীমারেখা। সুতরাং এর কাছেও যেও না। এমনিভাবে আল্লাহ তাঁর নির্দেশাবলি মানুষের জন্য সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করেন, যাতে তারা সতর্কতা অবলম্বন করতে পারে।’ (সুরা বাকারা : ১৮৭)

ইতিকাফের আগে আল্লাহর কাছে মনে মনে কিছু দাবি-দাওয়া স্থির করে নিলে ভালো হয়। যেগুলো আমরা মসজিদে অবস্থান নিয়ে আল্লাহর কাছে চাইব। নীরবে-নিভৃতে কান্নাকাটি করে ওইসব দাবি পেশ করব। দাবি আদায়ে আল্লাহর কাছে জোরালো দরখাস্ত করব। দুনিয়াতে যেমন বিশেষ দাবিতে মানুষ রাস্তায় অবস্থান নেয় বা কারও ঘরের দরজায় লুটিয়ে পড়ে থাকে। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত ওই জায়গা ছাড়বে না ভাব ধরে। ইতিকাফটাও এমনই একটা বিষয়। ইতিকাফ মানে দুনিয়ার যাবতীয় সম্পর্ক ছিন্ন করে মহান প্রভুর কাছে বিশেষ দাবিতে তাঁর ঘরে অবস্থান নেওয়া। এমনভাবে আবেদন করা যে, দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত এখান থেকে সরব না। আর দাবির আগে কিছু আমলও করতে হবে। ইতিকাফে বসে সৎ ও ভালো কথাবার্তা বলতে হবে। কোরআন তেলাওয়াত, জিকির-আজকার, তাহাজ্জুদ ও বিভিন্ন নফল নামাজ, দরুদ শরিফ ও ধর্মীয় কিতাবাদি পাঠ করতে হবে। বিশেষ করে হাজার মাস ইবাদতের চেয়েও বেশি সওয়াবের রাত শবে কদর লাভের আশায় ২১ রমজান থেকে ২৯ রমজান পর্যন্ত বেজোড় রাতগুলো ও ঈদের রাতে বেশি বেশি ইবাদত করতে হবে।

ইতিকাফ মানুষকে দুনিয়ার ঝামেলা ত্যাগ করে নিবিষ্ট মনে ইবাদতের শিক্ষা দেয় এবং অল্প সময়ের জন্য হলেও আল্লাহর সঙ্গে তার সম্পর্ক জুড়ে দেয়। এতে মানুষের পক্ষে অন্তিমকালে দুনিয়া ত্যাগ করা সহজ হয় এবং দুনিয়ার মহব্বতের পরিবর্তে আল্লাহর মহব্বত বৃদ্ধি পায়। ইতিকাফকারীর উদাহরণ সেই হাজতি ব্যক্তির মতো, যে কোনো মহান ব্যক্তির দরবারে হাত পেতে থাকে এবং বলে, যে পর্যন্ত না আমার হাজত পূর্ণ করা হয়, আমি এই দরবার ত্যাগ করব না। অতএব, আমাদের সবারই ইতিকাফের স্বাদ নেওয়া উচিত এবং এটিকে জীবনের মহামূল্য সুযোগ মনে করা উচিত। কোনো কারণে নিজে না পারলেও অন্যকে ইতিকাফে বসার জন্য উৎসাহ দেওয়া এবং ইতেকাফকারীদের সাহায্য করা উচিত।

খালেদ / পোস্টকার্ড ;