বাইপাসের কাজ প্রায় শেষ, ফৌজদারহাট-বায়োজিদ সড়ক চালু হবে কবে!

বাইপাসের কাজ প্রায় শেষ, ফৌজদারহাট-বায়োজিদ সড়ক চালু হবে কবে!
বাইপাসের কাজ প্রায় শেষ, ফৌজদারহাট-বায়োজিদ সড়ক চালু হবে কবে

নিজস্ব প্রতিবেদক ।।

ফৌজদারহাট-বায়েজিদ বহুল প্রত্যাশিত  সড়কের ৯৫ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে। তবু এটি চালু করা সম্ভব হচ্ছে না। বর্ষা, করোনার কারণে কাজ করা সম্ভব না হওয়া এবং পাহাড় নিয়ে সৃষ্ট সংকট এই পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। অবশ্য আগামী তিন মাসের মধ্যে সড়কটি চালু করার চেষ্টা করছে বলে জানিয়েছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)। একটি ওভারব্রিজ, ছয়টি ব্রিজের ১২টি জয়েন্ট এবং পাহাড় ব্যবস্থাপনা নিয়ে কাজ শেষ করার পরই এটি চালু করা হবে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চট্টগ্রামের প্রথম এই বাইপাস সড়ক চালু হলে নগরীর যান চলাচলে গতি আসবে। পাশাপাশি আবাসন, শিল্পায়ন এবং পর্যটনে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।

সিডিএর দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা জানান, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সীতাকুণ্ডের ফৌজদারহাট থেকে নগরীর বায়েজিদ পর্যন্ত সড়ক নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয় বেশ আগে। ১৯৯৭ সাল থেকে এ নিয়ে কাজ করছে সিডিএ। শুরুতে ১৯৯৯ সালে ৩৩ কোটি ৮১ লাখ টাকা ব্যয়ে সড়কটি নির্মাণের একটি প্রকল্প একনেক পাস হয়। একনেকে পাস হলেও প্রকল্পটি আলোর মুখ দেখেনি। পরে ২০০৪ সালে ছয় কিলোমিটার দীর্ঘ চার লেনের সড়কটি নির্মাণের জন্য ৫৫ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়। ফৌজদারহাট থেকে কাজ শুরু করে ব্রিজসহ নানা অবকাঠামো গড়ে তোলা হয়। এক পর্যায়ে রাস্তাটি নিয়ে আপত্তি তোলে এশিয়ান উইম্যান ইউনির্ভাসিটি। এই রাস্তার জন্য যখন ভূমি হুকুম দখল করা হয় তখন এশিয়ান উইম্যান ইউনিভার্সিটিকেও ১০৪ একর ভূমি প্রদান করা হয়েছিল। রাস্তা নির্মাণের সময় দেখা যায়, প্রায় ৪ হাজার ফুট বা ১.২২ কিলোমিটার রাস্তা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০৪ একর এলাকার মধ্যে পড়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে তাদের ক্যাম্পাসের ভিতর দিয়ে রাস্তা যাওয়ার ব্যাপারে আপত্তি তোলে। তারা সড়কের ওই অংশটি তাদের নিকট হস্তান্তর করে ক্যাম্পাসের বাইরের অংশ দিয়ে তৈরির দাবি জানায়। ক্যাম্পাসের ভিতর দিয়ে যাওয়া রাস্তা অভ্যন্তরীণ রোড হিসেবে ব্যবহার করবে বলে শর্ত দেয়। সিডিএ আপত্তি করলে বেঁকে বসে এশিয়ান উইম্যান ইউনিভার্সিটি। আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানটি চট্টগ্রাম থেকে সিলেট চলে যাওয়ার হুমকি দেয়া হয়। ওই অবস্থায় রাস্তাটির বিভিন্ন অংশ নির্মিত হলেও কাজ বন্ধ হয়ে যায়। পরিত্যক্ত হয় পুরো প্রকল্প। পরবর্তীতে দফায় দফায় বৈঠকে রাস্তাটি নির্মাণের গুরুত্ব সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে তুলে ধরা হয়। সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে এশিয়ান উইম্যান ইউনির্ভাসিটির ভিতর দিয়ে যাওয়া রাস্তাটি তাদের ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। একই সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের উত্তর পাশ ঘেঁষে নতুন করে রাস্তা নির্মাণের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করা হয়। নতুন করে গ্রহণ করা হয় প্রকল্প। ব্যয় নির্ধারণ করা হয় প্রায় ২১০ কোটি টাকা। পরে কিছু খরচ কাটছাঁট করে প্রকল্প ব্যয় ১৭২ কোটি ৪৯ লাখ ৩২ হাজার টাকায় নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু দফায় দফায় সময় বৃদ্ধি পেতে থাকে। আগে করা কাজগুলোও পরিত্যক্ত হয়ে যাওয়ায় নতুন করে প্রকল্প ব্যয় দাঁড়ায় ৩২০ কোটি টাকায়।

ছয় কিলোমিটার দীর্ঘ এই রাস্তাটির জন্য মোট ৯১৯.৭৮ কাঠা জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। একটি রেলওয়ে ওভারব্রিজ নির্মাণসহ ৬টি ব্রিজ নির্মাণ করা হয়। কয়েকটি কালভার্টও রয়েছে। পাহাড়ের ভিতর দিয়ে রাস্তাটি নির্মাণ করা হচ্ছে। রাস্তাটি করার জন্য অনেকগুলো পাহাড় কাটা পড়েছে। পাহাড়ের ভিতর দিয়ে আনা এই রাস্তায় পাহাড় কাটার জন্য সিডিএকে জরিমানা করে পরিবেশ অধিদপ্তর। বিষয়টি নিয়ে আইনি প্রক্রিয়া চলছে।

সিডিএ সূত্র জানায়, রাস্তাটির প্রায় কাজ শেষ হয়েছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম রেললাইনের উপর আগের ওভারব্রিজটি পরিত্যক্ত হওয়ায় বর্তমানে নতুন করে একটি ওভারব্রিজ নির্মাণ করতে হচ্ছে। এছাড়া রাস্তা জুড়ে থাকা ছয়টি ব্রিজের বারোটি জয়েন্টের কাজ বাকি রয়েছে। একই সাথে কয়েকটি কালভার্টের জয়েন্টের কাজও করতে হবে। তবে সবচেয়ে বড় সংকট তৈরি হয়েছে পাহাড় নিয়ে। রাস্তাটি নির্মাণকালে সিডিএ ছোট-বড় মিলে ১৭টি পাহাড় কাটে। এর মধ্যে ৭টি পাহাড় কাটা হয়েছে একেবারে খাড়াভাবে। এভাবে খাড়া পাহাড় কেটে পরিবেশের বড় ধরনের ক্ষতি করা হয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। একইভাবে রাস্তাটির পাশে খাড়া পাহাড় পরবর্তীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে বলে উল্লেখ করেন তারা। বর্ষাকালে এসব পাহাড় ধসে পড়ে মানুষের জীবন এবং সম্পদের জন্য ক্ষতির কারণ হবে। তারা পরিবেশসম্মতভাবে পাহাড়গুলো ব্যবস্থাপনা করার জন্য সিডিএকে নোটিশ প্রদান করেন। এই অবস্থায় পাহাড়গুলো কীভাবে ব্যবস্থাপনা করা যায়, পরিবেশ অধিদপ্তরের গাইড লাইন কী, তা নিয়ে সিডিএ থেকে পরামর্শ চাওয়া হয়েছে।

সিডিএর প্রকল্প পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার রাজিব দাশ বলেন, পরিবেশ অধিদপ্তর যেভাবে বলবে আমরা সেভাবে পাহাড় ব্যবস্থাপনা করব। এখন পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে গাইড লাইনের অপেক্ষা করছি। তিনি বলেন, আমাদের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। তবে একটি ব্রিজ, বারোটি ব্রিজের জয়েন্টসহ কিছু কাজ বাকি রয়েছে। এগুলো দ্রুত শেষ করে রাস্তাটি চালু করার ইচ্ছে থাকলেও করোনার কারণে সম্ভব হচ্ছে না। পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলে বাকি কাজ এবং পাহাড় ব্যবস্থাপনার বিষয়টি শেষ করে সড়কটি চালু করে দেয়া হবে। তবে রাস্তার বাকি কাজ শেষ করার ক্ষেত্রে বর্ষাও অন্তরায় বলে উল্লেখ করেন তিনি।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নগরীর যান চলাচলে গতি আনতে সড়কটি দ্রুত চালু করা জরুরি। তারা বলেন, নগরীর প্রবেশমুখ সারা দিন স্থবির থাকে। কর্নেল হাট থেকে এ কে খান মোড়, জাকির হোসেন রোড থেকে জিইসি এবং সন্নিহিত এলাকায় রাতে-দিনে যানজট লেগে থাকে। বড় বড় প্রাইম মুভার, রডের গাড়ি, সিমেন্টের গাড়ি, পণ্যবাহী ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান মিলে সকাল থেকেবেহাল অবস্থা হয়। বাইপাস সড়কটি পুরো এলাকার চেহারা পাল্টে দেবে। এই সড়কটি ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ফৌজদারহাট থেকে এসে বায়েজিদ রোডের সাথে যুক্ত হয়েছে। বায়েজিদ রোড অক্সিজেন মোড়ে গিয়ে সংযুক্ত হয়েছে অঙিজেন-কুয়াইশ সড়কের সাথে। এতে করে ঢাকা থেকে সীতাকুণ্ড পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকা থেকে আসা যেসব গাড়ি উত্তর চট্টগ্রামের হাটহাজারী, ফটিকছড়ি, রাউজান, রাঙুনিয়া, কাপ্তাইসহ সন্নিহিত অঞ্চলে কিংবা খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি, বান্দরবান এবং কঙবাজারসহ দক্ষিণ চট্টগ্রামে যাবে সেসব গাড়ি শহরে প্রবেশ না করে এই রাস্তা ধরে গন্তব্যে পৌঁছতে পারবে। আবার শহর বা উপরোক্ত অঞ্চলগুলো থেকে যেসব গাড়ি ঢাকা কিংবা দেশের অপরাপর অংশে যাবে, সেগুলো বাইপাস রোড ধরে বেরিয়ে যেতে পারবে।

অপরদিকে মীরসরাই, সীতাকুণ্ড এবং ফৌজদারহাট থেকে রড এবং স্টিল আনা-নেয়ার জন্য প্রতিদিন অসংখ্য প্রাইম মুভার শহরের ভিতর দিয়ে নাসিরাবাদ শিল্প এলাকায় যাতায়াত করে। রডবাহী বিশাল গাড়িগুলো জাকির হোসেন রোডে ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি করে। তার ধকল পুরো এলাকার যান চলাচলের ক্ষেত্রে পড়ে। প্রতিদিন গভীর রাত পর্যন্ত প্রাইম মুভারের দখলে থাকে জাকির হোসেন রোড। রাস্তাটি চালু হলে এই ধরনের বিপুল সংখ্যক গাড়ির চাপ থেকে নগরী রক্ষা পাবে। এর প্রভাব পড়বে পুরো নগরীর যান চলাচলের ক্ষেত্রে। পাশাপাশি ফৌজদারহাট-বায়েজিদ বাইপাস চালু হলে পুরো এলাকাটি আবাসন এবং শিল্পায়নের নেটওয়ার্কে চলে আসবে। পর্যটনেও এই সড়ক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। দুই মাথায় প্রতিবন্ধকতা দেওয়া হলেও বর্তমানে মোটর সাইকেলসহ নানা ধরনের বাহন নিয়ে প্রতিদিন অনেক মানুষ এই সড়কে ভ্রমণ করতে যান। করোনাকালেও রাস্তাটি অনেকের বিনোদনের অংশ হয়ে উঠেছে।

পরিবেশ অধিদপ্তরের চট্টগ্রামের বিভাগীয় পরিচালক মোহাম্মদ মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, রাস্তা চালু করবে সিডিএ। এতে আমাদের কিছু বলার নেই, দেখারও নেই। আমরা পরিবেশের বিষয়টি দেখছি। ইতোমধ্যে তাদের ১০ কোটি টাকা জরিমানা করা হয়েছে। তারা আপিল করেছে। শুনানি হবে। তারা পাহাড় কাটার ব্যাপারে কোনো নিয়মকানুন মানেনি। সিডিএ প্ল্যান দেয়ার সময় ইউরোপিয়ান স্টাইলে ২:১ সিস্টেমে পাহাড় কাটার কথা। অর্থাৎ হাইট দুইশ ফুট হলে তারা ১০০ ফুট স্লোব করে কাটবে। কিন্তু তা না কেের কোথাও কোথাও ৯০ ডিগ্রি, কোথাও ১১০ ডিগ্রি খাড়া করে কেটেছে। পাহাড় রাস্তার দিকে হেলে রয়েছে। এতে পরিবেশের ক্ষতির পাশাপাশি বড় ধরনের ঝুঁকিও তৈরি করেছে।

পরিবেশ অধিদপ্তরের অপর একজন কর্মকর্তা বলেন, রাস্তাটি গুরুত্বপূর্ণ, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ এই রাস্তাটি পাহাড় ম্যানেজ করে নির্মাণ করা যেত। সিডিএ তা করেনি। যে পাহাড়গুলো কেটে ফেলা হয়েছে এখন সেগুলোকে ঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করে রাস্তাটি চালু করতে হবে। আমরা সিডিএকে পাহাড় ব্যবস্থাপনা (মেইনটেনেন্স) করতে বলেছি। এখন তারা পরিবেশসম্মতভাবে মেইনটেনেন্স করলে আমাদের আপত্তি থাকবে না। আমরাও চাই রাস্তাটি চালু হোক। তবে তা পরিবেশের সর্বনাশ কিংবা মানুষের জন্য ঝুঁকি সৃষ্টি করে নয়। সুত্র. আজাদী