বাংলাদেশ শিল্প বিপ্লবের পথে

বাংলাদেশ শিল্প বিপ্লবের পথে
বাংলাদেশ শিল্প বিপ্লবের পথে

এসএম আলমগীর।।

দেশ এগিয়ে যাচ্ছে কৃষিনির্ভর অর্থনীতি থেকে শিল্পনির্ভরতার দিকে। এ জন্য সরকার শিল্পের বিকাশকে অধিক গুরুত্ব দিচ্ছে। যে ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে উঠছে সেগুলোকে ঘিরেই শিল্প বিপ্লবের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। সবখানেই চলছে বিশাল কর্মযজ্ঞ, গড়ে উঠছে একেকটি বৃহৎ শিল্প কারখানা। ইতোমেধ্যই কর্মসংস্থান হয়েছে হাজার হাজার লোকের, ঘুরতে শুরু করেছে কলের চাকা, চলছে উৎপাদন। অর্থনৈতিক অঞ্চলের কারখানায় উৎপাদিত পণ্য দেশের চাহিদা মিটিয়ে এখন দখল নিচ্ছে বিশ্ববাজারেও। আর এভাবেই বদলে যাচ্ছে বাংলাদেশ।
শিল্পের বিপ্লব ঘটাতে সরকার ২০১০ সালে অর্থনৈতিক অঞ্চল আইন পাস করে। সবকিছুর মতোই শুরুতে অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগটি বেশি গুরুত্ব পায়নি। তবে গতি আসে ২০১৫ সাল নাগাদ। এরপর থেকেই জমি অধিগ্রহণ, ভূমির উন্নয়ন থেকে শুরু করে সব কাজ দ্রুত এগিয়ে চলছে। ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চলের মধ্যে ইতোমধ্যে ৮৮টির অনুমোদন দিয়েছে সরকার। এগুলোয় এখন চলছে বিশাল কর্মযজ্ঞ। সব অর্থনৈতিক অঞ্চল চালু হলে কর্মসংস্থান হবে প্রায় দেড় কোটি লোকের। অর্থনৈতিক অঞ্চলের কারখানায় পণ্য উৎপাদন শুরু হলে দেশের চাহিদা মিটিয়ে রফতানি হবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে।
২০৩০ সাল নাগাদ এ ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল সম্পূর্ণভাবে প্রস্তুত করা হবে। সে ক্ষেত্রে সব অর্থনৈতিক অঞ্চলের কারখানায় পুরোদমে পণ্য উৎপাদন হবে। বাড়তি আরও প্রায় ৪০ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রফতানি হবে। বর্তমানে প্রতিবছর ৬ থেকে ৮ শতাংশ হারে পণ্য রফতানিতে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। ২০৩০ সাল নাগাদ দেশের রফতানি আয় স্বাভাবিক গতিতেই ৬৫ থেকে ৭০ বিলিয়ন ডলার ছাড়াবে। এর সঙ্গে অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোর রফতানি যোগ হলে ওই সময়ের মধ্যে ১০০ বিলিয়ন ডলারের রফতানি আয় ছাড়িয়ে যাবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
এ বিষয়ে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও পলিসি রিসার্স ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, বর্তমানে দেশে অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে নানা সঙ্কট রয়েছে। তাই বলে ভালো কিছুও যে হচ্ছে না, তা নয়। দেশের অর্থনীতির ভালোর জন্য যেমন ১০টি মেগা প্রকল্পের কাজ এগিয়ে চলছে, তেমনি সরকার যে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তুলছে সেগুলোও দেশের অর্থনীতিকে ইতিবাচক দিকে এগিয়ে নেবে। সরকার অনুধাবন করছে এ একবিংশ শতাব্দীতে শিল্পকে গুরুত্ব না দিলে দেশকে এগিয়ে নেওয়া যাবে না। তাই অর্থনৈতিক অঞ্চলকে সব ধরনের সহযোগিতা দেওয়া হচ্ছে সরকারের তরফ থেকে। এটা অবশ্যই ভালো দিক। তিনি আরও বলেন, দেশে খুব বেশি ইপিজেড নেই, বৃহৎ আকারের পরিকল্পিত শিল্পনগরীও তেমন একটি ছিল না। ১০০ শিল্পনগরীতে একদিকে যেমন কর্মসংস্থান হবে প্রায় দেড় কোটি লোকের, তেমনি দেশের অর্থনীতির চাকাকে আরও গতিশীল করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। তবে শিল্পের উন্নয়নের ক্ষেত্রে দেশের সব অঞ্চলকেই গুরুত্ব দিতে হবে।
শিল্প উদ্যোক্তারাও অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোকে ঘিরে আশায় বুক বেঁধে আছেন। এ বিষয়ে এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি মীর নাসির হোসেন বলেন, ‘আমাদের দেশে এখনও পর্যন্ত শিল্প কারখানা গড়ে উঠেছে অপরিকল্পিতভাবে। এ কারণে পর্যাপ্ত গ্যাস-বিদ্যুৎ, অবকাঠামোসহ সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যায় না। বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোয় একই সঙ্গে গ্যাস-বিদ্যুৎ ও অন্য সুবিধা পর্যাপ্ত পাওয়া যাবে। এ জন্য দেশের অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যে ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল আশির্বাদ হয়ে আসবে বলে আমি মনে করি।
বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্যও দেওয়া হচ্ছে আলাদা আলাদা অর্থনৈতিক অঞ্চল। বিদেশিদের মধ্যে ভারত, জাপান, চীন, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, সুইজারল্যান্ড, জার্মানি, হংকং, সৌদি আরবসহ বেশ কয়েকটি দেশ বিনিয়োগ করবে শত শত বিলিয়ন ডলার। এসব দেশের সঙ্গে সরকারের সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়েছে। ইতোমধ্যেই অনেক দেশ বিনিয়োগ শুরু করেছে।
আর দেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ইতোমেধ্যই এসিআই, পিএইচপি, বিএসআরএম, অনন্ত গ্রুপ, ডিবিএল গ্রুপ, এনার্জি প্যাক, সামিট অ্যালায়েন্স পোর্ট, বসুন্ধরা, মেঘনা গ্রুপ, সিটি গ্রুপ, টিকে গ্রুপসহ অনেক প্রতিষ্ঠান অর্থনৈতিক অঞ্চলে জমি নিয়েছে।
অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোয় বিনিয়োগে সবচেয়ে এগিয়ে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাত। আছে কেমিক্যাল ও রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলপিজি) খাত এবং স্টিল, অটোমোবাইলস, পেইন্টসহ বিভিন্ন খাতের বিনিয়োগও। এসব খাতের সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ চুক্তিবদ্ধ হয়েছে চট্টগ্রামের মিরসরাই, সীতাকুণ্ড ও ফেনীর ৩০ হাজার একর জমি গড়ে ওঠা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরে। এখানেই গড়ে উঠবে একটি স্বপ্নের শিল্পনগরী।
এ শিল্পনগরীতেই এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে। বেজার হিসাবে, বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে এখন পর্যন্ত বিনিয়োগ প্রস্তাব ১ হাজার ৩৪০ কোটি ডলারের। এতে জমি নিয়েছে ৬৯টি প্রতিষ্ঠান। তা ছাড়া মহেশখালী অর্থনৈতিক অঞ্চলে জমি নিয়েছে ২টি প্রতিষ্ঠান। তাদের বিনিয়োগ প্রস্তাবের পরিমাণ ২৪৮ কোটি ডলার। অন্যদিকে শ্রীহট্ট অর্থনৈতিক অঞ্চলের পুরো জমি নিয়ে নিয়েছে ৬টি প্রতিষ্ঠান। তাদের মোট বিনিয়োগ প্রস্তাব ১৩১ কোটি ডলার। এভাবে যে ৮৮টি অর্থনৈতিক অঞ্চলের অনুমোদন দিয়েছে সরকার সেগুলোয় মিলিয়ন-বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ আসছে।
এদিকে বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চলের ৬টিতে বিনিয়োগকারীরা ইতোমেধ্যই কারখানা করছে। এর মধ্যে মেঘনা ইকোনমিক জোনে ১০টি, মেঘনা ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইকোনমিক জোনে ১৫টি, সিটি ইকোনমিক জোনে ৬টি, আবদুল মোনেম ইকোনমিক জোনে ১টি, আমান ইকোনমিক জোনে ৫টি ও বে-ইকোনমিক জোনে ২টি কোম্পানি কারখানা করছে। ৩৯টির মধ্যে উৎপাদন শুরু করেছে ৩০টি কারখানা। এসব কারখানার উৎপাদিত পণ্য রফতানিও শুরু হয়েছে।
বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের নির্বাহী চেয়ারম্যান পবন চৌধুরী বলেন, সরকার ২০৩০ সাল নাগাদ ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরির লক্ষে কাজ করে যাচ্ছে। বর্তমানে ২৮টির কাজ চলছে জোরেশোরে। এর মধ্যে ১৩টি সরকারি খাতের, বেসরকারি খাতের ১৫টি। পর্যায়ক্রমে আমরা নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই আমরা সব অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রস্তুত করতে সক্ষম হব বলে আশা করছি। তিনি আরও বলেন, বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগের জন্য আর জমির সঙ্কট হবে না। বেজার হাতে ইতোমধ্যেই ৫০ হাজার একর জমি এসেছে। এখন দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আসছে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের। আমরা বিনিয়োগকারীদের জন্য বিনিয়োগের ক্ষেত্র তৈরি করে বসে আছি, সে সঙ্গে আমরা তাদের নীতি-সহায়তা দিতে সবসময় প্রস্তুত রয়েছি।
পবন চৌধুরী আরও বলেন, একশটি অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের পর শুধু ১ কোটি মানুষের কর্মসংস্থানই সৃষ্টি হবে না, বছরে অতিরিক্ত ৪০ বিলিয়ন ডলারের পণ্যও রফতানি হবে। যা আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশকে উন্নত দেশ হতে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যাবে। এতে বর্তমান সরকারের ভিশন-২০২১ এবং উন্নত দেশ গড়ার স্বপ্ন ২০৪১-এর বাস্তবায়ন সম্ভব হবে। সে সঙ্গে অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোর হাত ধরেই বাংলাদেশে শিল্প বিপ্লব ঘটবে বলে আমাদের প্রত্যাশা।