মাইগভ অ্যাপস: সকল সেবা এখন হাতের মুঠোয় - শাকিল আহমেদ

মাইগভ অ্যাপস: সকল সেবা এখন হাতের মুঠোয়  - শাকিল আহমেদ
মাইগভ অ্যাপস: সকল সেবা এখন হাতের মুঠোয় - শাকিল আহমেদ

১১ হাজার ৫৪৭টি সরকারি অফিসের সেবা মিলছে ‘মাইগভ’ নামের একটি অ্যাপসে। সব নাগরিকের জন্য সরকারি সেবা সহজ করার লক্ষ্যে বানানো হয়েছে এই অ্যাপস। ইতোমধ্যে মাইগভ অ্যাপসের মাধ্যমে সরকারি সেবা পেতে ২৩.৭০ লাখ আবেদন জমা পড়েছে। সরকারি সেবাগ্রহীতারা এর সুফলও পেতে শুরু করেছেন। 

বেসরকারি একটি ব্যাংকের কর্মকর্তা মো. জামিল হোসেন তার বীর মুক্তিযোদ্ধা বাবার সম্মানী ভাতার জন্য এক সপ্তাহ উপজেলা কমিটির কাছে ঘুরেও কোনো উপায় পাচ্ছিলেন না। এরপর ‘মাইগভ’ বা ‘আমার সরকার’ অ্যাপসে আবেদন করে ৬০ দিনের মধ্যে বাবার নাম তুলেছেন সম্মানী ভাতার তালিকায়।

নিজের অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে সময়ের আলোকে তিনি বলেন, “আমার বাবা একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু তিনি কোনো ভাতা পেতেন না। এরপর বাবার নাম সম্মানী ভাতার তালিকায় তুলতে দিনাজপুরের চিরিরবন্দর উপজেলায় বেশ কয়েক দিন ঘুরেছি কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। 

সেখানকার কর্মকর্তারা বলেছেন, মিটিংয়ের রেজুলেশনের কপি হারিয়ে গেছে। এ অবস্থায় কী করব ভেবে পাচ্ছিলাম না। এরপর একদিন মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট ঘাঁটাঘাঁটি করছিলাম। হঠাৎ চোখে পড়ল ‘মাইগভ’ লেখাটা। কৌতূহল নিয়ে সেখানে ক্লিক করলাম এবং অ্যাপসটি সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারলাম। সেখানে ভাতার জন্য আবেদন করলাম দু’মাসের মধ্যে আমার বাবার নাম তালিকায় তোলা হলো। এটা ছিল আমার কাছে অবিশ্বাস্য। যেখানে সরাসরি ঘুরে ব্যর্থ হয়েছি সেখানে ঘরে বসে কোনো ঝামেলা ও হয়রানি ছাড়াই সেবা পেয়েছি। সত্যিই ‘মাইগভ’ সরকারের একটি অনন্য উদ্যোগ।”

অনলাইনে তথ্য সংশোধনের জন্য আবেদন করেছেন মোহাম্মদ মোস্তাফা কামাল। অল্প সময়ে ঝামেলা ছাড়া সংশোধন করতে পেরে তিনিও খুশি। 

তবে ভিন্ন অভিজ্ঞতাও রয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা বাবার নাম গেজেটভুক্তি করার জন্য সাত মাস আগে আবেদন করেছিলেন ছেলে মাহবুব মোর্শেদ কবির। তিনি এখনও সুরাহা পাননি। 

সময়ের আলোকে তিনি বলেন, ‘সাত-আট মাস আগে বাবার নাম গেজেটভুক্তি করার জন্য মাইগভে আবেদন করেছিলাম- এরপর আমাকে জানানো হয় এটি নাকি বন্ধ রয়েছে। এরপর আর কোনো যোগাযোগ করেনি। পরে আমি ম্যানুয়ালি করেছি।’

জনগণের দোরগোড়ায় সব ধরনের সেবা পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে এবং প্রশাসনিক ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটানোর উদ্যোগ নেয় সরকার। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৫ সালে একসেস টু ইনফরমেশন (এটুআই)-এর নির্দেশনায় সরকারের বিভিন্ন সেবা ডিজিটালাইজেশনের কাজ শুরু হয়। এরপর ২০১৯ সালে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশের অবদান এক ঠিকানায় সব সমাধান’ স্লোগান নিয়ে সরকারি সব সেবা একক প্ল্যাটফর্মে পেতে একসেবা নামক একটি ওয়েবসাইট তৈরি করা হয়।

একসেবার সব সেবা আরও সহজতর করতে ‘আমার সরকার বা মাইগভ’ অ্যাপস তৈরির পরিকল্পনা করা হয় এবং এর কাজ শুরু হয়। এরপর ২০২০ সালের ৮ জানুয়ারি রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে (বিআইসিসি) ‘তৃতীয় ডিজিটাল বাংলাদেশ দিবস ২০১৯ সম্মাননা প্রদান’ অনুষ্ঠানে অ্যাপসটির উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অ্যাপসটি তৈরিতে ব্যয় হয়েছে চার কোটি ৬৯ লাখ টাকা। এখন পর্যন্ত অ্যাপসটিতে ২৯টি মন্ত্রণালয় সংযুক্ত করা হয়েছে। 

এ ছাড়া সাতটি ক্যাটাগরিতে এক হাজার ৯০১টি সেবা ডিজিটালাইজড করা হয়েছে। এ ছাড়া এক হাজার ৩৮৯টি সরকারি সেবা অ্যাপসটিতে ইন্টিগ্রেট করা হয়েছে এবং মাইগভে ১১ হাজার ৫৪৭টি সরকারি অফিস সংযুক্ত রয়েছে। ইতোমধ্যে মাইগভ সিস্টেমটি ৩৪.১৩ লাখেরও অধিক নাগরিক রেজিস্ট্রেশন করেছেন এবং মাইগভের মাধ্যমে সরকারি সেবাগ্রহণের জন্য ২৩.৭০ লাখেরও বেশি আবেদন এসেছে, যার মধ্যে ২২ লাখ ১৮ হাজারেরও অধিক নাগরিক আবেদনের নিষ্পত্তি করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে সব সরকারি ও প্রয়োজনীয় বেসরকারি সেবা এই অ্যাপে সংযুক্ত হওয়ার কথা রয়েছে। কোভিড-১৯ এবং কোভিড-পরবর্তী সময়ে যে কোনো অচলাবস্থায় সরকারি সেবাগুলোকে সচল রাখতে এ উদ্যোগ নিয়েছিল সরকার।

একজন সেবাগ্রহণকারী চাইলে যে কোনো সময় যে কোনো স্থান থেকে এই অ্যাপের মাধ্যমে সব সেবার আবেদন করতে পারবেন। আবেদনের অগ্রগতি জানতে পারবেন এবং সেবা-সংশ্লিষ্ট ফি অনলাইনে পরিশোধ করতে পারবেন। জাতীয় পরিচয়পত্রের মাধ্যমে সেবা গ্রহণকারীর পরিচয় নিশ্চিত করা যাবে। সেবা গ্রহণের সময় যে কোনো জটিলতা অথবা মাইগভে ব্যবহারে সক্ষম না হলে অ্যাপ থেকেই ৩৩৩-তে কল করে সেবা নিতে পারবেন। 

এ ছাড়াও অধিকতর সহযোগিতার জন্য মাইগভ বা আমার সরকার স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিকটস্থ ডিজিটাল সেন্টারের সঙ্গে সংযুক্ত করবে। জরুরি প্রয়োজনে মাইগভ অ্যাপস থেকে সরাসরি ৯৯৯-এ কল করেও জরুরি সেবা নেওয়া যাবে। কেউ বিপদে পড়লে অ্যাপসটি খুলে মোবাইল ফোন ঝাঁকালে সরাসরি ৯৯৯ নম্বরে চলে যাবে ফোন। একই সঙ্গে ব্যবহারকারীরা ৩৩৩ নম্বরে কল করেও নানা ধরনের তথ্য ও সেবা নিতে পারবেন অ্যাপটি থেকে। প্রয়োজনীয় তথ্যের সেবার জন্য আবেদন, কাগজপত্র দাখিল, আবেদনের ফি পরিশোধ এবং আবেদন-পরবর্তী আপডেট জানা যাবে অ্যাপেই। শুধু ভয়েস ব্যবহার করেও সেবার আবেদন ও আপডেটসহ অন্যান্য বিষয় জানা যাবে। আর আবেদনকারীর পরিচয় নিশ্চিত করা হবে জাতীয় পরিচয়পত্রের সাহায্যে। অন্যদিকে অ্যাপসটি যন্ত্রের সঙ্গে কথোপকথন প্রযুক্তি সংযোজিত হওয়ায় বিশেষভাবে সক্ষম ব্যক্তি এবং সাধারণ নাগরিকরা প্রযুক্তি-জ্ঞান ছাড়াও সহজে ব্যবহার করতে পারবেন।

আমার সরকার বা ‘মাই গভ’ মোবাইল অ্যাপ তৈরিতে কারিগরি সহযোগিতা করছে আইটি প্রতিষ্ঠান অরেঞ্জ বিজনেস ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড (অরেঞ্জবিডি লিমিটেড)। 

এ প্রসঙ্গে অরেঞ্জ বিডি লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আল-আশরাফুল কবীর জুয়েল বলেন, ‘বর্তমানে মাইগভ অ্যাপসে ২৯টি মন্ত্রণালয়ের এক হাজার ৯০১টি সেবা এখন পর্যন্ত ডিজিটালাইজেশন করা হয়েছে। অ্যাপস তৈরিতে চার কোটি ৬৯ লাখ টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। এই ব্যয়ের মধ্যে রয়েছে সফটওয়ার ডেভেলপমেন্ট ও সেবা ডিজিটালাইজেশন। সেবা ডিজিটালাইজেশনের কাজটি করছে এটুআই। এটি একটি চলমান কাজ। ২০২৩ সালের মে মাস পর্যন্ত আমাদের কন্ট্রাক্ট আছে। এরপর আবারও নতুন করে টেন্ডার আহ্বান করা হবে। তখন যে প্রতিষ্ঠান কাজ পাবে তারা করবে।’

এ প্রসঙ্গে একসেস টু ইনফরমেশনের (এটুআই) প্রকল্প পরিচালক ডা. দেওয়ান মুহাম্মদ হুমায়ূন কবীর (যুগ্মসচিব) সময়ের আলোকে বলেন, “সরকারি সব সেবা এক প্ল্যাটফর্মে আনার অঙ্গীকার নিয়ে ‘আমার সরকার বা মাইগভ’ প্ল্যাটফর্ম চালু করা হয়েছে। প্রয়োজনীয় তথ্যের সেবার জন্য আবেদন, কাগজপত্র দাখিল, আবেদনের ফি পরিশোধ এবং আবেদন-পরবর্তী আপডেট জানা যাবে অ্যাপেই। ইতোমধ্যে প্ল্যাটফর্মটি র‌্যাপিড ডিজিটাইলাজেশনের আওতায় ১,৯০১টি সেবা ডিজিটালাইজেশন করা হয়েছে। এ ছাড়াও আরও সরকারি-বেসরকারি সেবা অ্যাপটিতে যুক্ত করা হবে।”

তিনি বলেন, ‘জাতীয় তথ্য বাতায়ন, সোশ্যাল মিডিয়া, এটুআইয়ের ফেসবুক পেজ ও বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের নিজস্ব কৌশলে প্রচার করা হবে। যেমন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সনদ সংশোধন, ডিজিটাল বিজনেস আইডি (ই-কমার্স উদ্যোক্তাদের জন্য), বিদেশগামীদের শিক্ষা সনদ যাচাই, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনেক সেবা ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কনস্যুলার সার্ভিস ইত্যাদি। অন্যান্য মন্ত্রণালয়গুলো যার যার সেবা প্রচার করবে- প্রচারের সব মাধ্যম ব্যবহার করে। এটুআই সেক্ষেত্রে কারিগরি সহায়তা দেবে।’

খালেদ / পোস্টকার্ড ;