মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে আলেমদের মতামত

মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে আলেমদের মতামত

একাত্তরে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন হয় সোনার বাংলাদেশ। পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে অর্জিত হয় বাঙালি জাতির গৌরবান্বিত বিজয়। ইসলামে স্বাধীনতা অর্জন, বিজয় উদযাপন ও দেশপ্রেমের রয়েছে মহান তাৎপর্য। এ প্রসঙ্গে কয়েকজন সচেতন আলেমের মতামত তুলে ধরেছেন আমিন ইকবাল

বিজয় আল্লাহর বিশেষ নিয়ামতমুফতী মুরতাজা হাসান ফয়েজী
খতিব, গুলশান সোসাইটি মসজিদ গুলশান, ঢাকা১৬ ডিসেম্বর আমাদের বিজয় দিবস। বিজয় মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশেষ নেয়ামত। যেকোনো নেয়ামত প্রাপ্তিতে মানুষ মাত্রই আনন্দিত হয়। কিন্তু আনন্দের আতিশয্যে বিজয় উৎসব করতে গিয়ে অনেকেই আল্লাহকে ভুলে যায়। হারিয়ে যায় কোরআন সুন্নাহ বিবর্জিত অপসংস্কৃতির অতল গহ্বরে। যা আদৌ ইসলাম সমর্থন করে না।
মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে ‘আল ফাতহ তথা বিজয়’ শিরোনামে একটি সুরা নাজিল করেছেন। বিজয় কীভাবে উদযাপন করতে হয় সে বিষয়েও কোরআন সুন্নাহ স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। সুরা নাসরের মধ্যে আল্লাহ বলেন, ‘যখন আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে সাহায্য ও বিজয় আসবে তখন মানুষদের তুমি দেখবে, তারা দলে দলে আল্লাহর দ্বীনে প্রবেশ করছে। অতঃপর তুমি তোমার মালিকের প্রশংসা কর এবং তার কাছেই ক্ষমা প্রার্থনা কর; অবশ্যই তিনি তাওবা কবুলকারী।’ (সুরা আন-নাসর : ১-৩)
এই সুরায় আল্লাহ তায়ালা বিজয় অর্জনের পর আমাদের দুটি কাজ করতে বলেছেন। এক. বিজয় অর্জিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মহান আল্লাহর তাসবিহ পাঠ করে তার দরবারে সদা-সর্বদা শোকরিয়া জ্ঞাপন করা। দুই. আল্লাহর কাছে কায়মনোবাক্যে সবসময় ক্ষমা প্রার্থনা করা।
মনে রাখতে হবে, যে আল্লাহ আমাদের বিজয় দান করেছেন, সেই আল্লাহ আবার আমাদের এ বিজয় যেকোনো সময় কেড়ে নিতে পারেন। আল্লাহ বলেন, ‘(হে নবী) তুমি বল, হে রাজাধিরাজ (মহান আল্লাহ), তুমি যাকে ইচ্ছা তাকে সাম্রাজ্য দান কর, আবার যার কাছ থেকে চাও তা কেড়েও নাও, যাকে ইচ্ছা তুমি সম্মানিত কর, যাকে ইচ্ছা তুমি অপমানিত কর; সব রকমের কল্যাণ তো তোমার হাতেই নিবদ্ধ; নিশ্চয়ই তুমি সব কিছুর ওপর একক ক্ষমতাবান।’ (সুরা আলে ইমরান : ২৬)। অতএব, বিজয়ের নেয়ামত হারানোর আগেই আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করতে হবে এবং তার বিধানাবলী মেনে দুনিয়ার জীবন কাটাতে হবে।

 

নিজেকে পরিশুদ্ধ করাই প্রকৃত বিজয়
মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী
চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ মুফাসসির সোসাইটি
বাংলাদেশের ইতিহাসে ১৬ই ডিসেম্বর এক অনন্য দিন। এদিন আমরা অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে এক অসম যুদ্ধে জয়লাভ করেছি। আমরা ছিলাম প্রায় নিরস্ত্র-মজলুম, ওরা ছিল আধুনিক অস্ত্রসস্ত্রে সজ্জিত-জালেম। আল্লাহ তায়ালা মজলুমের বিজয় দিয়েছেন। জালেমকে করেছেন চির লাঞ্ছিত, অপমানিত এবং লজ্জাজনক পরাজিত।
ভারত ভাগের সময় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টগবগে তরুণ। পাকিস্তান আন্দোলনে ছিলেন অগ্রণী সৈনিক। তিনি লিখেছেন, ‘পাকিস্তান না আনলে মুসলমানদের বাঁচানো যাবে না।’ পাকিস্তান আসল ঠিকই। কিন্তু এবার ঘরের মানুষই শত্রু বনে গেল। বাংলাদেশের মানুষের ওপর চরম নির্যাতন এবং বৈষম্যমূলক আচরণ করল পাকিস্তানি শাসকরা। এ যেন নিষ্ঠুর এজিদের শাসন ব্যবস্থার কথাই মনে করিয়ে দিয়েছিল আরেকবার।
আরেকটি যুদ্ধ হলো। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলার নির্যাতিত মানুষ স্বাধীনতা পেল। এক যুদ্ধে জয়লাভ করে সাহাবিদের উদ্দেশে নবীজি (সা.) বলেছিলেন, ‘আমরা এখন ছোট যুদ্ধ থেকে বড় যুদ্ধে এসেছি। বড় যুদ্ধ হলো নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করা।’ বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও বঙ্গবন্ধু, মাওলানা ভাষানীসহ জাতীয় নেতৃবৃন্দ একই কথা বললেন। আমাদের এখন নিজেদের জয় করতে হবে। তাহলেই দেশ বিজয় স্বার্থক হয়ে ওঠবে। এরপর বঙ্গবন্ধু শহীদ হলেন, অন্যান্য মনীষীরা পরপারে চলে গেলেন, আফসোস! এ দেশের মানুষ এখনও নিজেদের আত্মাকে জয় করা তো দূরের কথা এর প্রয়োজনীয়তাও উপলদ্ধি করতে পারছে না।
এক সাগর রক্তের বিনিময়ে পাওয়া দেশটি বিশে^র বুকে দুর্নীতিতে হেরে গেছে। এ দেশের প্রতিটি মানুষই অন্যায়-অরাজকতার স্রোতে কোনো না কোনোভাবে নিজেকে ভাসিয়ে দিয়েছে, কেউ অন্যায় করে আর কেউ অন্যায় সয়ে। তাই আজ বিজয় দিবসকে সামনে রেখে বলতে চাই, বাইরের শত্রু থেকে আমরা স্বাধীন হয়েছি ঠিকই কিন্তু ভেতরের শত্রু থেকে আজও আমরা স্বাধীন হতে পারিনি।
ভেতরের শত্রু বলতে এ দেশের মানুষ, যারা নিজের বিবেক এবং আত্মাকে ধর্মের আলোয় পরিশুদ্ধ করে নেননি তাদের বোঝানো হচ্ছে। কলুষিত আত্মা এবং অসুস্থ বিবেকওয়ালা ওইসব মানুষ দেশ-জাতি-সর্বোপরি নিজের শত্রু হয়ে আছে। এদের কারণেই দেশ এগুতে পারছে না। জাতি বড় হচ্ছে না। প্রজš§ সঠিক পথে চলতে পারছে না। আমরা যদি স্বাধীনতার সত্যিকার সুফল পেতে চাই তাহলে নিজের নফসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে আমাদের জয়ী হতে হবে। নিজের ভেতরে লুকিয়ে থাকা লোভ-লালসা-হিংসা-বিদ্বেষ যখন জয় করতে পারব, তখনই আমরা সত্যিকারের স্বাধীন হতে পারব।

ইসলামে পতাকার সম্মান অসীমগাজী সানাউল্লাহ রাহমানী
খতিব, মোহাম্মদীয়া হাউজিং সোসাইটি জামে মসজিদ মোহাম্মদপুর, ঢাকা
পতাকা মর্যাদা ও গৌরবের প্রতীক। একটি পতাকা একটি জাতি বা রাষ্ট্রের পরিচয় ও প্রমাণ। প্রত্যেকেই নিজের সম্প্রদায়ের পতাকাকে শ্রদ্ধা করে। ইসলামেও রয়েছে পতাকার আলাদা গুরুত্ব ও মহিমা। আরবিতে পতাকা বোঝাতে দুটি শব্দ ব্যবহার হয়। একটি ‘আলাম’। আরেকটি ‘রায়াহ’। মসজিদে রায়াহ নামে একটি মসজিদ আছে মক্কায়। মসজিদে হারাম অর্থাৎ কাবা ঘরের সন্নিকটে। নবীজি (সা.) যখন মক্কা বিজয় করতে আসেন তখন এ মসজিদের প্রাঙ্গণেই বিজয়ের পতাকা গেঁথেছিলেন। সেই ইতিহাস রক্ষার্থে আজও সেখানে দাঁড়িয়ে আছে মসজিদে রায়াহ বা পতাকা মসজিদ। হজরত জাবের (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘রাসুল (সা.) মক্কা বিজয়ের সময় যখন প্রবেশ করছিলেন তখন তার পতাকার রঙ ছিল সাদা।’ (তিরমিজি)
পতাকা কেবল একটি কাপড় নয়। বরং এটি আবেগের একটি দাস্তান। সম্মানের একটি নিশানা। স্বাধীনতার এক ঘোষণা। প্রতিটি জাতির আলাদা আলাদা পতাকা রয়েছে। আর সেই পতাকার সঙ্গে জড়িয়ে আছে সেই জাতির ইতিহাস-ঐতিহ্য। গর্ব ও অহঙ্কার। ইসলামের পরতে পরতে এই পতাকার ইতিহাস পাওয়া যায়। প্রায় সব নবীদের যুগেই এই পতাকার আলোচনা এসেছে। ইসলামের ইতিহাসে দেখা যায় সর্বপ্রথম পতাকা ব্যবহার করেছিলেন হজরত ইবরাহিম (আ.)।
আমাদের নবী (সা.) মদিনায় এসে নতুন রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন করেন। ইসলামের দাওয়াত নিয়ে মুসলিম কাফেলা ছুটতে থাকে দেশ থেকে দেশান্তরে। নবীজি (সা.)-এর দোয়া ও পয়গাম সঙ্গে ছুটে চলা এই সাহসী কাফেলার হাতে থাকত কালেমা খচিত পতাকা। দ্রুতগতিতে ছুটে চলা ঘোড়া কিংবা উটের পিঠে পতপত করে উড়ত ইসলামের পতাকা। কখন পাহাড়, কখন নদী, কখনও মরুভূমি। এভাবেই ছুটে চলত ইসলামের পতাকা। নবীজি (সা.)-এর জমানায় প্রায় ৮৬টি যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। সব কটি যুদ্ধের সঙ্গেই পতাকার ইতিহাস জড়িয়ে আছে। এ প্রসঙ্গে মুতার যুদ্ধটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
নিজ দেশের, নিজ স্বাধীনতার নিশানা এই পতাকাকে সম্মান করা ইসলামের অনুপম নির্দেশনা। দেশ, মাটি ও মাতৃভূমি যেমনি পবিত্র ও মর্যাদাবান তেমনি দেশের পতাকাও সম্মানিত ও মর্যাদাবান। তাই দেশকে ভালোবাসার পাশাপাশি দেশের পতাকাকে ভালোবাসতে হবে। আমাদের পতাকার মাঝে যে লাল সবুজের চিত্র এতে কেবল রঙ নয় বরং সবুজ জমিনের ওপর লাখো শহীদের এক বুক রক্ত। এই সবুজ জমিনের ছায়া আর শহীদের রক্তলাল আদর্শের মায়া আমাদের হৃদয়ে জাগ্রত করতে হবে। তবেই দেশ হবে সোনার বাংলা। আর আমরা হব সত্যিকারের আদর্শ দেশপ্রেমিক।

দেশপ্রেমে দৃঢ় থাকতে হবেমুফতী উবায়দুল্লাহ বিন সাঈদ
সভাপতি, রাবেতাতুল ওয়ায়েজীন গাজীপুর জেলাস্বাধীনতা মানুষের মজ্জাগত একটি মৌলিক অধিকার, তাই মানুষের মনকে কোনো খাঁচায় বন্দি করে রাখা যায় না। মানবতার মুক্তিদূত মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেন, প্রত্যেক নবজাতক স্বভাবধর্মে অর্থাৎ ইসলাম নিয়ে জন্মগ্রহণ করে তার পিতা-মাতা তাকে বিভিন্ন ধর্মে শৃঙ্খলাবদ্ধ করে (ইয়াহুদ, খ্রিস্টান, অগ্নিপূজক বানায়)। (বুখারি : হাদিস ১৩১৯)
আমরা যদি ইতিহাসের পাতার দিকে লক্ষ্য করিÑ দেখতে পাব আমরা জাতি হিসাবে কখনও পরাধীনতাকে মেনে নিতে পারিনি। বাংলা নামের এই অখণ্ড জনপদটি গৌড়, বঙ্গ, পুণ্ড্র এ রকম প্রায় ১৬টি জনপদ নিয়ে গঠিত হওয়ার পর থেকে ১৫৩৮ সাল পর্যন্ত স্বাধীন ছিল। কিন্তু চূড়ান্ত পরাধীনতা বরণ করে ১৭৫৭ সালে ইংরেজের কাছে, ইংরেজের বিরুদ্ধে প্রথম থেকেই বাংলার মানুষ ছিল প্রতিবাদমুখর, ব্রিটিশ বেনিয়াদের হাত থেকে মুক্তি পেতে আমাদের সময় লাগে প্রায় ১৯০ বছর পর। এরপর পাকিস্তানের ২৩ বছরের শোষণ-নির্যাতনের পর ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের বিনিময়ে বিজয় অর্জন করি।
এই তো দুদিন পরই আমাদের বিজয় দিবস। আমরা কি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারব যে, আমরা একটি শোষণমুক্ত, দুর্নীতিমুক্ত জাতি তৈরি করতে পেরেছি? আমরা কি প্রকৃত স্বাধীনতা, মানুষের মৌলিক অধিকার, বাক স্বাধীনতা, স্বাধীনভাবে ধর্মপালন, নিরাপদে চলাফেরা করা, ব্যবসা, শিক্ষা কার্যক্রম চালাতে পারি? পারি না। কারণ আমরা যেদিকে তাকাই দেখতে পাই দুর্নীতির মহোৎসব, ক্যাসিনো বাণিজ্য, সুদ-ঘুষের বাণিজ্য, নির্যাতন, যত্রতত্র খুন, ধর্ষণ, লুটতরাজ, সবলের দ্বারা দুর্বল নির্যাতনের শিকার। তাই প্রকৃত স্বাধীনতা অর্জনের জন্য ধর্মপরায়ণতা ও দেশপ্রেম নিয়ে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। ইসলামই মানুষের মৌলিক অধিকার ও প্রকৃত স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখতে পারে।