শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে শ্রদ্ধা-ভালোবাসায় জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের স্মরণ

শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে শ্রদ্ধা-ভালোবাসায় জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের স্মরণ
শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে শ্রদ্ধা-ভালোবাসায় জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের স্মরণ

নিজস্ব প্রতিবেদক ।।

অশ্রুতে লেখা রক্তের আখরের নক্ষত্রের মতো জ্বলজ্বলে শহীদ বুদ্ধিজীবীর নাম। লাল-সবুজের মানচিত্রে রক্তের দাগ। সেই দাগ শুকিয়েছে অনেক আগেই। কিন্তু রক্তের ঋণ ভুলেনি বাঙালি। মুক্তির মন্ত্র নিতে তাই ছুটে আসে বারবার। কোটি বাঙালির শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় সিক্ত হলেন জাতির অমর শ্রেষ্ঠ সন্তানরা। ভোরের আলো ফুটতেই বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধগুলোতে ঢল নামে সর্বস্তরের জনতার। জীর্ণ জাতির বুকে আশা জাগানিয়া শ্রেষ্ঠ সন্তানদের দুয়ারে হাজির শ্রদ্ধাবনত জাতি। হাজারো মানুষের ঢলে নেই কোনো ভেদাভেদ। বয়োজ্যেষ্ঠদের পাশাপাশি নতুন প্রজন্মের উপস্থিতি ছিল আশাব্যঞ্জক। মানুষ হত্যা করা যায়। কিন্তু মেরে ফেলা যায় না আদর্শ, নষ্ট করা যায় না স্বপ্ন। চিরন্তন এই বাণী মর্মে ধরে পূর্বপুরুষের স্বপ্নের ডানায় ভর করে আজও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ বাঙালি।
 শনিবার শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে শ্রদ্ধা জানাতে আসা মানুষের কণ্ঠে ছিল উন্নত-সমৃদ্ধ অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়। ছিল ইতিহাস বিকৃতকারীদের রুখে দেওয়ার শপথ। সাম্প্রদায়িক শক্তির ধারক-বাহকদের প্রত্যাখ্যান এবং নতুন প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জাগিয়ে তুলতে সঠিক ইতিহাসের চর্চার দাবিও ছিল মানুষের মাঝে। একই সঙ্গে দিবসটি উপলক্ষে আয়োজিত বিভিন্ন সমাবেশ থেকে বিদেশে পালিয়ে থাকা বুদ্ধিজীবী হত্যাকারীদের দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের রায় দ্রুত কার্যকর করার দাবি জানানো হয়েছে।
দিবসটি উপলক্ষে শনিবার সকালে কালো পতাকা উত্তোলন ও জাতীয় পতাকা অর্ধনমিতকরণ, শহীদদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ, আলোচনাসভা, শহীদদের স্মরণে মোমবাতি প্রজ্বালন, শোক র‌্যালি, শ্রদ্ধা নিবেদন, চিত্রাঙ্কন, সাধারণ জ্ঞান ও হাতের লেখা প্রতিযোগিতা, মিলাদ ও দোয়া মাহফিলসহ বিভিন্ন কর্মসূচির আয়োজন করা হয়।
১৯৭১ সালের এই দিনে চ‚ড়ান্ত বিজয়ের মাত্র দুদিন আগে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসররা পরিকল্পিতভাবে দেশের কৃতী সন্তানদের হত্যা করে। তারপর থেকে দিনটি শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।
শহীদ বুদ্ধিজীবীদের শ্রদ্ধা জানাতে সকালে মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে সর্বস্তরের মানুষের ঢল নেমেছিল। ভোরের সূর্য ওঠার আগেই হাজারো মানুষ ভিড় করেন মিরপুরের শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধের সামনে। সবার হাতে ছিল ফুলের তোড়া ও শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে লেখা কালো ব্যানার।
রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের চ‚ড়ান্ত বিজয়ের একদিন আগে দেশ ও জাতির জন্য আত্মোৎসর্গকারী মহান বীরদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সকাল সাতটায় পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করেন। শ্রদ্ধা নিবেদনের পর রাষ্ট্রপতি সেখানে কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন। এ সময় বিউগলে করুণ সুর বেজে ওঠে। পুষ্পস্তবক অর্পণের পর রাষ্ট্রপতি যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ বুদ্ধিজীবী পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেন এবং তাদের খোঁজ-খবর নেন।
পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মিরপুরে শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। পুষ্পস্তবক অর্পণের পর জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেখানে কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন। এ সময় বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর একটি চৌকস দল রাষ্ট্রীয় সালাম জানায়। এ সময় বিউগলে করুণ সুর বেজে ওঠে। মন্ত্রিপরিষদের সদস্যবৃন্দ, সংসদ সদস্য, তিন বাহিনীর প্রধান, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র এবং উচ্চ পর্যায়ের সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তারা এ সময় উপস্থিত ছিলেন।
আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা দলীয় প্রধান হিসেবে কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে নিয়ে শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে আরেকটি পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। এ সময় আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু, সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সভাপতি মন্ডলীর সদস্য বেগম মতিয়া চৌধুরী, অ্যাডভোকেট আব্দুল মতিন খসরু, ড. আব্দুর রাজ্জাক, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ, জাহাঙ্গীর কবির নানক ও আব্দুর রহমান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
এ ছাড়াও স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন। শ্রদ্ধা নিবেদনের পর উপস্থিত যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ বুদ্ধিজীবী পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন তিনি। এ ছাড়া মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বী মিয়া পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের নেতৃত্বে শহীদ পরিবারের সদস্য ও বীর মুক্তিযোদ্ধারা বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে এবং রায়েরবাজার বধ্যভ‚মি স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন।
দিবসটি উপলক্ষে শনিবার সকাল ৮টায় ধানমন্ডিস্থ ৩২ নম্বর ভবনের সামনে রক্ষিত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। শেখ হাসিনা প্রথমে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এবং পরে আওয়ামী লীগ সভাপতি হিসেবে দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। পরে একে একে মিরপুর শহীদ বেদীতে শ্রদ্ধা জানায় কেন্দ্রীয় ১৪ দল, শহীদ পরিবারের সন্তান ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধারা।
এ ছাড়াও বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ, বাংলাদেশ ওয়াকার্স পার্টি, বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি, বাসদ, গণফোরামসহ বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন শহীদ বুদ্ধিজীবীদের শ্রদ্ধা জানিয়ে রায়েরবাজার বধ্যভ‚মি সমাধিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। এদিকে বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে জাতীয় প্রেসক্লাবের গ্রন্থাগারে মুক্তিযুদ্ধ কর্নারের উদ্বোধন করা হয়েছে। গ্রন্থাগারে ফিতা কেটে মুক্তিযুদ্ধ কর্নার উদ্বোধন করেন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকরা।
বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র মিলনায়তনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এক আলোচনা সভার আয়োজন করে। এতে সভাপতির বক্তব্য রাখেন উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান।
দিবসটি উপলক্ষে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে সকাল সাড়ে ১০টায় বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে পবিত্র কোরআনখানি, মিলাদ ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় দেশের জন্য আত্মদানকারী শহীদ বুদ্ধিজীবীদের রুহের মাগফিরাত কামনা করে দোয়া করা হয়।
এদিকে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে রায়েরবাজার বধ্যভ‚মিতে শহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে প্রতীকী অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছে কেন্দ্রীয় খেলাঘর আসর। ‘স্মৃতিতে রায়েরবাজার বধ্যভ‚মি’ শীর্ষক এ অবস্থান কর্মসূচিতে খেলাঘরের সদস্যরা সাদা কাপড় পরে চোখে কালো কাপড় বেঁধে অবস্থান নেন।
এ ছাড়া একাত্তরে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে বধ্যভ‚মিতে যেভাবে ফেলে রেখে যাওয়া হয়েছিল, অভিনয়ের মাধ্যমে সেই প্রতীকী দৃশ্য রচনা করেন জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের স্মরণ ও শ্রদ্ধা জানিয়েছেন খেলাঘরের সদস্যরা।
শিল্পকলা একাডেমির উদ্যোগে ছিল যন্ত্রসঙ্গীত, গান, কবিতা পাঠ ও আবৃত্তি অনুষ্ঠানের। যাতে বক্তব্য রাখেন শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী। আয়োজনে একক সঙ্গীত পরিবেশন করেন স্বরলিপি ও মাইনুল আহসান।