সচেতনতার অভাবে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ছে,সীতাকুণ্ডের এক হাসপাতালেই সপ্তাহে ৫১ রোগী ভর্তি

সচেতনতার অভাবে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ছে,সীতাকুণ্ডের এক হাসপাতালেই সপ্তাহে ৫১ রোগী ভর্তি
সচেতনতার অভাবে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ছে,সীতাকুণ্ডের এক হাসপাতালেই সপ্তাহে ৫১ রোগী ভর্তি

পোস্টকার্ড  ডেস্ক ।। 

সীতাকুণ্ডের দক্ষিণ সলিমপুর এলাকার শালেহ আহম্মদ । বুধবার সকাল থেকে শরীরে প্রচণ্ড কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসে। দুপুরের পর তাপমাত্রা ১০৩ ডিগ্রি ফারেনহাইট হয়ে যায়। সেই সাথে পেটব্যথা ও বমি হচ্ছিল । স্থানীয় চিকিৎসকের পরামর্শে রক্ত পরীক্ষার পর তাঁর ডেঙ্গু শনাক্ত হয়। এরপর তিনি স্থানীয় বিআইটিআইডি হাসপাতালে ভর্তি হন।

শুধু শালেহ আহম্মদ না, সীতাকুণ্ডের ফৌজদারহাটে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজেস (বিআইটিআইডি) হাসপাতালে গত এক সপ্তাহে ৫১ ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন।

সবচেয়ে আতঙ্কের বিষয় হচ্ছে , সীতাকুণ্ডের সোনাইছড়ি ইউনিয়নের দক্ষিণ শীতলপুর গ্রামে ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়েছেন শতাধিক মানুষ। এলাকার প্রতিটি পরিবারের এক বা একাধিক বিভিন্ন বয়সী নারী-পুরুষ ও শিশুরা ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়েছেন। আক্রান্তদের মধ্যে কেউ কেউ বাসায় চিকিৎসা নিলেও অধিকাংশ রোগী হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছে।

স্থানীয়রা জানিয়েছেন, আক্রান্তদের মধ্যে অধিকাংশই চিকিৎসার জন্য সীতাকুণ্ডের বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্রাফিক্যাল অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজেস (বিআইটিআইডি) হাসপাতাল ও চমেক হাসপাতালসহ নগরীর বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। তাঁদের এলাকার প্রতিটি ঘরে প্রতিদিনই কেউ না কেউ জ্বরে আক্রান্ত হচ্ছেন। আক্রান্তরা চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী পরীক্ষা-নিরীক্ষা করানোর পর ডেঙ্গু জ্বর শনাক্ত হচ্ছে। এদিকে একই এলাকায় শতাধিক ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হওয়ার পরও ডেঙ্গুর প্রকোপ ঠেকাতে কোন ধরনের ব্যবস্থা নেয়নি ইউপি চেয়ারম্যান, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স কিংবা উপজেলা প্রশাসন। এলাকাজুড়ে বৃদ্ধি পাওয়া ডেঙ্গুর প্রকোপ ঠেকাতে মশক নিধনে স্থানীয় বাসিন্দারা ইউনিয়ন পরিষদের দ্বারস্থ হলেও তারা কোন ধরনের সহায়তা না করে উল্টো উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা বরাবরে লিখিত আবেদন জমা দিতে বলেন।

বিআইটিআইডি হাসপাতাল সূত্র জানায়, গত এক সপ্তাহে ( মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত) ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত শতাধিক রোগী ভর্তি রয়েছে। যাদের মধ্যে ২৫ জনেরও অধিক রোগী সোনাইছড়ি ইউনিয়নের দক্ষিণ শীতলপুর এলাকার। এছাড়া হাসপাতালটিতে মঙ্গলবার সকাল থেকে দুপুরের মধ্যে ভর্তি হয়েছেন ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত ৭ রোগী। হাসপাতালটিতে গত এক মাসে ডেঙ্গু আক্রান্ত শতাধিক রোগী ভর্তি হয়েছেন। হাসপাতালটিতে গত এক মাসে ডেঙ্গু আক্রান্ত শতাধিক রোগী ভর্তি হয়েছেন।

এবার হাসপাতালটিতে সব বয়সের নারী-পুরুষ, শিশু রোগী ভর্তি হলেও ২০-৬৫ বছরের রোগীর সংখ্যাই বেশি। তবে রোগীদের ডেঙ্গুর ধরণ এখনও নির্ণয় করা যায়নি। গতবারের তুলনায় এবারের ডেঙ্গুর ধরণ কিছুটা আলাদা। ভর্তি হওয়া রোগীদের রক্তচাপ ও রক্তের অনুচক্রিকাও (প্লাটিলেট) কিছুটা কম পাওয়া যাচ্ছে। তবে সবাই সুস্থ আছেন বলে জানা যায় ।

বিআইটিআইডি হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, গত এক মাসে শতাধিক ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন। তাদের মধ্যে শহর ও গ্রামাঞ্চলের রোগী রয়েছে। হাসপাতালের ভৌগোলিক অবস্থান সীতাকুণ্ডের ফৌজদারহাটে হওয়ায় এ উপজেলার ভাটিয়ারী, কুমিরা, পাক্কা রাস্তার মাথা, সলিমপুরের বাসিন্দা রোগীর সংখ্যা একটু বেশি। তাছাড়া রয়েছে চট্টগ্রামের বিশ্ব কলোনি, আকবর শাহ, পাহাড়তলি, উত্তর কাট্টলী, হালিশহর এলাকার রোগীও ।

হাসপাতালের বিভিন্ন ইউনিটে দেখা যায়, নির্দিষ্ট শয্যার পাশাপাশি হাসপাতালের অন্য ইউনিটেও ডেঙ্গু রোগীদের ভর্তি করে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। তবে ভর্তিকৃত রোগীর অধিকাংশ শয্যায় মশারি টাঙানো নেই। চিকিৎসকেরা মশারি টানাতে বললেও অনীহা রোগীদের।

চিকিৎসা নিতে আসা সীতাকুণ্ডের কুমিরার জাহানারা (৩৫) বলেন, চার-পাঁচ দিন ধরে তার জ্বর, পেটব্যথা ও বমি হচ্ছিল। স্থানীয় চিকিৎসকের পরামর্শে রক্ত পরীক্ষার পর ডেঙ্গু শনাক্ত হলে সে বিআইটিআইডি হাসপাতালে ভর্তি হন। এখানে চিকিৎসার পর বর্তমানে জ্বর থাকলেও বমি ও পেটব্যথা অনেকটাই কমেছে।

সীতাকুণ্ড উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. নুর উদ্দিন রাশেদ বলেন, আমরা নিয়মিত মানুষকে সচেতন করতে উঠান বৈঠক, সভা-সেমিনার করে যাচ্ছি। প্রতি সপ্তাহে ৩-৪ টি সভা করা হচ্ছে। আমাদের হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্য সহকারী, পরিদর্শক সকলেই সম্মিলিতভাবে কাজ করছে। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ডেঙ্গু পরীক্ষার ব্যবস্থাও রয়েছে। প্রত্যেক ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদেরকে মশক নিধন কার্যক্রম পরিচালনার জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে বলা হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত সীতাকুণ্ড উপজেলা স্বাস্থ কমপ্লেক্সে কোন রোগী ভর্তি হয়নি। এমনিতে যে ক'জন ডেঙ্গু রোগী আসছেন তাঁরা আউটডোরে চিকিৎসা নিয়ে চলে যাচ্ছেন।

বিআইটিআইডি হাসপাতালে গত আড়াই বছর ধরে ডেঙ্গু ও করোনা নিয়ে কাজ করছেন হাসপাতালটির সহযোগী অধ্যাপক মামুনুর রশীদ। তিনি বলেন, ভর্তি হওয়া সব রোগীই সুস্থ আছেন। তাদের চিকিৎসা চলছে বেশ ভালোভাবেই। কোন ব্যত্যয় ঘটছে না। ওষুধ, রোগ নির্ণয় থেকে শুরু করে সরকারি সব ধরণের সাপোর্ট আছে। দ্বিতীয়ত রোগীদের রক্তচাপ ও রক্তের অনুচক্রিকা (প্লাটিলেট) কম পাওয়া যাচ্ছে। এটা ডেঙ্গুর নতুন ধরণ। তবে এর কারণে মৃত্যুঝুঁকি নেই। কোনো রোগীকে আইসিইউতেও পাঠানোর প্রয়োজন হয় না। তবে কেন রোগীর রক্তচাপ কম পাওয়া যাচ্ছে বা প্লাটিলেট কম পাওয়া যাচ্ছে, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এটা নিশ্চিত হতে বা কোন ডেঙ্গু ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে তা জানতে জেনেটিক এ্যানালাইসিস করতে হয়। এজন্য আমরা নমুনা সংগ্রহ করে সেই নমুনা ঢাকার রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে (আইইডিসিআর) পাঠিয়ে দিচ্ছি। রিপোর্ট আসার পর আমরা জানতে পারব ডেঙ্গুর ধরণ কী।

বিশেষজ্ঞ এ চিকিৎসক আরও বলেন, আমরা ২ ঘন্টায় রোগীর এনএস ওয়ান এন্টিজেন ও ৬ ঘন্টায় এন্টি ডেঙ্গু আইজিএম পরীক্ষা করতে সক্ষম হচ্ছি। এর মধ্য দিয়ে আমরা সহজেই জানতে পারছি রোগী ডেঙ্গু আক্রান্ত কিনা? এরপর চিকিৎসা শুরু হচ্ছে। ঢাকা থেকে রিপোর্ট পেতে সময় লাগলেও চিকিৎসায় কোনো ব্যাঘাত ঘটে না। সেটির সাথে চিকিৎসার কোনো সম্পর্ক নেই। সব ডেঙ্গুর চিকিৎসা একই।

তিনি বলেন, গত এক সপ্তাহে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের এক–তৃতীয়াংশ রোগী সীতাকুণ্ডের দক্ষিণ শীতলপুর, বড় কুমিরা, ছোট কুমিরা, ভাটিয়ারী ও সলিমপুর এলাকা থেকে আসা। এসব এলাকায় ঘরে ঘরে এক বা একাধিক সদস্য ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে বলে ভর্তি থাকা রোগীরা জানিয়েছেন। এক এলাকায় এত রোগী ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি উদ্বেগের। ডেঙ্গু আক্রান্তদের দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।

মামুনুর রশিদ আরও বলেন, সচেতনতার অভাবে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ছে। আমাদের দেশে ডেঙ্গুর চারটি উপসর্গই আছে। এটি প্রতিরোধ করতে হলে স্থানীয় পর্যায়ে সবাইকে সচেতন করতে হবে। বিশেষ করে স্কুল-কলেজ পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে সচেতনতা কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। তাহলে ডেঙ্গু প্রতিরোধ সম্ভব বলে জানান তিনি।

একই বিষয়ে সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ ইলিয়াছ চৌধুরী বলেন, চট্টগ্রামে ডেঙ্গু শনাক্ত ঊর্ধ্বমুখী রয়েছে। এ মাসের শুরু থেকেই শনাক্তের হার বাড়ছে। বছরের শুরুর দিকের চেয়েও এখন রোগী শনাক্ত হচ্ছে বেশি। তবে যেসব রোগী হাসপাতালে ভর্তি আছেন, তাঁদের মধ্যে কারও অবস্থা গুরুতর নয়। এই সময়টাতে এমনিতেই ডেঙ্গু সংক্রমণ বেড়ে যায়। তাই যেসব এলাকায় ডেঙ্গু রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি দেখা যাচ্ছে, সেই সব এলাকায় অবশ্যই মশক নিধন কার্যক্রম সঠিকভাবে পরিচালনা করতে হবে বলে জানান তিনি ।

খালেদ / পোস্টকার্ড ;