সীতাকুণ্ডের ত্রিপুরাদের অস্ত্র ঠেকিয়ে উচ্ছেদের চেষ্টায় আবুল খায়ের গ্রুপ!

সীতাকুণ্ডের ত্রিপুরাদের অস্ত্র ঠেকিয়ে উচ্ছেদের চেষ্টায় আবুল খায়ের গ্রুপ!
সীতাকুণ্ডের ত্রিপুরাদের অস্ত্র ঠেকিয়ে উচ্ছেদের চেষ্টায় আবুল খায়ের গ্রুপ!

সীতাকুণ্ড প্রতিনিধি ।। 

সীতাকুণ্ডের সোনাইছড়ি ত্রিপুরা পাড়ায় বসবাসরত ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের পাহাড়ি জনগোষ্ঠীকে অস্ত্র ঠেকিয়ে উচ্ছেদ করতে আবুল খায়ের গ্রুপ চেষ্টা চালাচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

জানা গেছে, মধ্যম সোনাইছড়ির পাহাড়ে অবস্থিত ত্রিপুরাপল্লীর বাসিন্দারা পাড়ায় জায়গার সংকুলান না হওয়ায় পাশের খাল সংলগ্ন একটি খোলা মাঠে কয়েকটি পরিবারের বসবাসের জন্য ঝুঁপড়ি ঘর তৈরি করে। কাঠ-বাঁশ আর ছন দিয়ে বানানো সেই ঘরে সন্তানদের নিয়ে ৬টি পরিবারের প্রবেশের পরই ঈদের দিন আবুল খায়ের গ্রুপের লোকজন আনসার সদস্যদের নিয়ে সেখানে হাজির হয়। তখন তারা সাফ জানিয়ে দেয়, এখানে কোন ঘর নির্মাণ করা যাবে না, এটি আবুল খায়ের গ্রুপের জায়গা।

সীতাকুণ্ড উপজেলার সোনাইছড়ি ইউনিয়নের মধ্যম সোনাইছড়ির পাহাড়ে অবস্থিত ত্রিপুরা পল্লীর বাসিন্দারা অভিযোগ করে জানান, গত শুক্রবার আনসার বাহিনীর সদস্যসহ আবুল খায়ের গ্রুপের লোকজন তাদেরকে পাড়া ছেড়ে চলে যাওয়ার হুমকি দিয়ে যান। পাড়া ছেড়ে না গেলে তাদেরকে মেরে ফেলা হবে বলেও হুমকি দেওয়া হয়।

মহাসড়ক থেকে ৩ কিলোমিটার দূরের মধ্যম সোনাইছড়ির ওই ত্রিপুরা পল্লীতে গতকাল গিয়ে দেখা যায়, ত্রিপুরা পল্লীর প্রবেশ মুখে পাহাড়ের পশ্চিম পাশের খোলা মাঠে ৬টি ছোট ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। যেখানে আদিবাসী নারীরা গৃহস্থালি কাজ ও শিশুরা খেলাধুলা করছে। স্থানের অভাবে তারা এখানে ঘর নির্মাণ করতে বাধ্য হয়েছেন বলে জানান।

এসময় কথা হয় ত্রিপুরা পল্লীর সর্দার কাঞ্চন ত্রিপুরার সাথে। তিনি বলেন, ‘আমরা স্বাধীনতার আগে থেকে কোন রকম নাগরিক সুবিধা ছাড়াই এখানে বসবাস করে আসছি। পাহাড়ে জুম চাষ করে আমরা জীবিকা নির্বাহ করে থাকি। দীর্ঘদিন এক জায়গায় থাকার কারণে পরিবার যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে তেমনি নতুন স্থানও পাওয়া যাচ্ছিল না। সামনের খোলা মাঠটিতে ইউএনও স্যার আমাদেরকে ১০ টি সরকারি ঘর করে দেয়ার কথা বলেছিলেন।’

কাঞ্চন ত্রিপুরা আরও বলেন, ‘বিষয়টি ইউপি সদস্য ও চেয়ারম্যান সাহেবও অবগত। আমরা সবাই জানি, মাঠটি সরকারি খাস জায়গা। কিন্তু হঠাৎ করে আবুল খায়ের গ্রুপ এটি তাদের বলে দাবি করছে। এরপর থেকে ১০টি ঘরের কাজ আর হচ্ছে না। ইউএনও স্যারও ঘরগুলো অন্যত্র দিয়ে দেন। তবুও আমরা সেখানে নিজ উদ্যোগে ঘর নির্মাণ করি। ঈদের দিন লাঠি-সোটা নিয়ে রেললাইন দিয়ে একদল ক্যাডার বাহিনী আমাদের পাড়ায় আসে। তাদের সাথে আনসাররাও ছিল। আনসার সদস্যরা আমাদের প্রতি এ্যাকশন মুডে অবস্থান নিয়েছিল এবং তাদের পক্ষ থেকে বিভিন্ন হুমকি-ধমকি দেওয়া হচ্ছিল। পরে আমরা প্রতিবাদ করলে তারা চলে যায়।’

ত্রিপুরা পল্লীর একজন বাসিন্দা বলেন, ‘আবুল খায়ের গ্রুপের লোকজনের সঙ্গে আসা আনসার সদস্যরা গত শুক্রবার আমাদের বুকের উপর বন্দুকের নল তাক করেছিল। লাঠি-সোটা নিয়ে শোডাউন দিচ্ছিল। আমাদের নারী-শিশুরা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল। তারা বার বার হুমকি দিচ্ছিল ঘরগুলো ভেঙে দেয়ার৷ আমরা এখন কোথায় যাবো? যেদিকে যাই শুধু বাধা আর বাধা। কোথাও যেন ঠাঁই নেই আমাদের।’

এদিকে বিরোধপূর্ণ জায়গাটি আবুল খায়ের গ্রুপ তাদের নিজস্ব সম্পত্তি বলেই দাবি করছে। এ বিষয়ে আবুল খায়ের গ্রুপের কর্মকর্তা ইমরুল কায়েস বলেন, ‘আমরা কারও জায়গা দখল করিনি। ত্রিপুরারাই আমাদের জায়গা দখল করেছে। ঈদের দিন আমরা কেউ না থাকার সুযোগে তারা আমাদের জায়গায় অনধিকার প্রবেশ করে জোরপূর্বক ঘর নির্মাণ করে ফেলে। আমাদের জায়গার উপর ঘর নির্মাণ সম্পূর্ণ বেআইনি। এভাবে আমাদের জায়গার উপর কাউকে ঘর নির্মাণ করতে দেওয়া হবে না।’

এদিকে ত্রিপুরা পাড়ার অন্যান্য বাসিন্দারাও আবুল খায়ের গ্রুপ নিয়ে মনে জমানো নানা ক্ষোভ ঝেড়েছেন। ত্রিপুরাপল্লীর একজন বাসিন্দা বলেন, ‘আবুল খায়ের গ্রুপ দীর্ঘদিন ধরে আমাদেরকে এলাকা থেকে উচ্ছেদ করতে চাইছে। জায়গাটির উপর তাদের অনেক লোভ। সমতল মাঠ হওয়ায় তারা এটির লোভ সামলাতে পারেনি। ইউএনও স্যার আমাদের ঘর তুলে দিবে শুনে তারা জায়গাটি দখলে নিতে চাইছে।’

ত্রিপুরা সর্দার কাঞ্চন ত্রিপুরার দেওয়া তথ্যমতে, সীতাকুণ্ডের মধ্যম সোনাইছড়িতে ৭০, ছোটদারোগারহাটে ৬, সীতাকুণ্ড পৌরসভায় ৪৫, বাঁশবাড়িয়ায় ২৫, সুলতানা মন্দিরে ৩৫, ছোট কুমিরায় ১২০, শীতলপুরে ৩০, মদনহাটে ১৬ ও আবুল খায়ের ফ্যাক্টরির ভিতরে ৩০ টি ত্রিপুরা পরিবার ১৯৭১ সালের আগে থেকে বসবাস করে আসছে।

ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী ত্রিপুরাদের রয়েছে নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি। জুম চাষ ও গবাধিপশু পালন করে জীবিকা নির্বাহ করা এসব পরিবারকে মানবেতর জীবনযাপন করতে হয়। তাদের দাবি, বিভিন্ন ভূমিদস্যুরা পাহাড়ের জায়গাগুলো দখল করে ফেলায় তারা এখন জুম চাষ করতে পারছে না। খালে আবুল খায়ের গ্রুপ দূষণ ছড়াচ্ছে। আগে মাছ ধরে আহার জুটানো গেলেও এখন তা আর হচ্ছে না।

ত্রিপুরা সর্দার কাঞ্চন ত্রিপুরা বলেন, প্রধানমন্ত্রীর ঘর উপহার পেতে গিয়েও পেলাম না। আবুল খায়ের গ্রুপ সেটি নস্যাৎ করে দিয়েছে। আমরা ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর লোকেরা তাদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছি। প্রতিনিয়ত তাদের উচ্ছেদের ভয়ে থাকতে হয়। ভয়ে ভয়ে দিন কাটাচ্ছি, কাজে যেতে পারছি না। আমরা পুরুষরা পাহাড়ে গেলে কখন এসে তারা সব ভেঙে দেয় সেই ভয়ে আছি।

তিনি বলেন, ‘আবুল খায়ের গ্রুপের ফ্যাক্টরির ভিতরে বসবাসরত ৩০টি ত্রিপুরা পরিবারকে সেখানে থাকতে হয় বলে ফ্যাক্টরিতে আধা বেতনে চাকরি করতে হয়। নিজেদের ভিটা ও ঘর ছাড়ার ভয়ে তারা সেখানে চাকরি করতে বাধ্য। এটি অমানবিকতা ও নিষ্ঠুরতা।’

অভিযোগ আছে, শুধু ঘর নির্মাণে বাধা দেয়া নয়, ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী ও মধ্যম সোনাইছড়ির নাগরিক জীবনেও বিরূপ প্রভাব ফেলছে আবুল খায়ের গ্রুপ।

স্থানীয় বাসিন্দা মো. আবুল হাশেম বলেন, ‘আবুল খায়ের গ্রুপ নির্বিঘ্নে তাদের ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমাদের কী কী সমস্যা হচ্ছে, সেটি কখনো তারা ভেবে দেখেনি। এই এলাকা দিয়ে প্রবাহিত হওয়া পাহাড়ি ছরার পানি আমরা খাওয়া, গোসল, ধোয়া-মোছা, মৎস্য শিকারসহ নিত্য প্রয়োজনীয় কাজে ব্যবহার করি। বলা চলে ছরার পানিই আমাদের পানির প্রধান উৎস। কিন্তু আবুল খায়ের গ্রুপের ফ্যাক্টরি থেকে এই ছরায় দূষিত বর্জ্যের দুর্গন্ধযুক্ত পানি ছেড়ে দেয়া হয়। ফলে আমরা ছরার পানি ব্যবহার করতে পারি না।’

তিনি আরও বলেন, ‘এ বিষাক্ত পানিতে অধিকাংশ মাছ ও জলজ প্রাণী মরে যায়। নিদারুণ পানির কষ্ট পোহাতে হয় আমাদের। আবুল খায়ের গ্রুপের দূষণে ছরার পানি দূষিত হওয়ায় ২০১৭ সালের জুলাই মাসে ছরার পানি পান করে হামে আক্রান্ত হয়ে ১০ জন ত্রিপুরা শিশুর মৃত্যু হয়েছে। এরপরও বন্ধ হয়নি আবুল খায়ের গ্রুপের দূষণ ছড়ানো।’

মধ্যম সোনাইছড়ির বাসিন্দা তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘আমাদের এলাকার উপর দিয়ে আবুল খায়ের গ্রুপ ৩৩ হাজার ভোল্টের বৈদ্যুতিক তার নিয়ে গেছে। বিশালাকৃতির বৈদ্যুতিক চতুর্ভূজ খুঁটি দীর্ঘ পথজুড়ে। এসবের কারণে আমরা আমাদের জায়গায় ভবন বা পাকা দালান করতে পারছি না। বর্ষাকালে লোহার হাতলের ছাতা ব্যবহার করে এসব তারের নিচের অংশ অতিক্রমকালে ‘শক’ করে। অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আমরা আছি।’

তিনি আরও বলেন, ‘আবুল খায়ের গ্রুপের দখল এতোটাই বেড়েছে যে, আশেপাশে পাহাড়-পর্বত, খাল কিছুই রাখছে না তারা। নিজেদের জায়গা ছাড়িয়ে পাশের পাাহাড়গুলোতেও স্ক্র্যাপের স্তূপ করে রাখছে আবুল খায়ের গ্রুপ।’

যে জায়গা থেকে ত্রিপুরাদের উচ্ছেদের চেষ্টা চলছে, সেই জায়গার বিষয়ে বন বিভাগের শীতলপুর বিটের বিট কর্মকর্তা মো. মজনু প্রামাণিক বলেন, ‘২ ও ৫ নং দাগের জায়গা নিয়ে মূলত সমস্যা। যেখানে ত্রিপুরারা ঘর নির্মাণ করেছে সে জায়গাটি আমরা খতিয়ে দেখছি। আমাদের বিএস রেকর্ডে ২, ৩, ৪ ও ৫ দাগে কোন জায়গা নাই। জনগণ ভাবতো এটি বন বিভাগের জায়গা। তবে এটি খাস খতিয়ান বা ব্যক্তি মালিকানার জায়গা হতে পারে।’

এ বিষয়ে সীতাকুণ্ড সহকারী কমিশনার (ভূমি) রাশেদুল ইসলাম বলেন, ‘সেখানে আমাদের কোন খাস জমি নেই। বন বিভাগ যদি বলে তাদের জায়গা তাহলে আমরা ব্যবস্থা নিব।’

সীতাকুণ্ড উপজেলা নির্বাহী অফিসার মিল্টন রায় বলেন, ‘আমি ১০ টি ঘর করে দেয়ার কথা বলেছিলাম। কিন্তু আবুল খায়ের গ্রুপ তাদের জায়গা দাবি করায় ঘরগুলো কুমিরার ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর মাঝে দিয়েছি। কারণ অন্যের জায়গায় আমি ঘর করবো কীভাবে? জায়গা নিয়ে সমস্যার সমাধান হলে তখন ভিন্ন কথা।’

তবে ১৬ মে আবুল খায়ের গ্রুপের কর্মকর্তারা জায়গার ‘কাগজপত্রের ফটোকপি’ ইউএনওকে দেখালে তিনি জায়গাটি আবুল খায়ের গ্রুপের ধরে নিয়ে সবুজ সংকেত প্রদান করেন। এ সময় উপস্থিত এ প্রতিবেদক জায়গাটির কাগজপত্রের কপি আবুল খায়ের গ্রুপের একজন কর্মকর্তার কাছে চাইলে তিনি দিতে অস্বীকৃতি জানান। এবং সাংবাদিকদের প্রতি বিষোদগার করে বলেন, ‘আল্লাহ সাংবাদিকদের হেদায়েত দিক, তারা বড় কোম্পানি পাইলেই হইছে, অমনি লেখা শুরু করে দেয়, কী লেখে? সত্য না মিথ্যা কিচ্ছু যাচাই করে না। ত্রিপুরারা আমার জায়গা দখল করলো আর আমি নাকি সন্ত্রাসী!’

এসময় আবুল খায়ের গ্রুপের কর্মকর্তা ইমরুল কায়েস ইউএনও’কে বলেন, ‘আপনি তাদের (ত্রিপুরাদের) বলে দেন সেখান থেকে ওঠে যেতে, এটি আমাদের জায়গা। আপনিই পাঁচ্যালটা করছেন। আপনি আমার ২ দাগ দখল করছেন, ৩ দাগ দখল করছেন এখন ৫ দাগ দখল করতেছেন। তাদের আমি ত্রাণ দিছি। আর এখন আমার জায়গা দখল করে। আপনি সমস্যা মিটমাট না করলে সেখানে খুনোখুনি হবে। আর সাংবাদিকদের বলে দেন এটা আমাদের জায়গা, তারা যেন উল্টাপাল্টা নিউজ না করে।’