সরকারি মহিলা শিক্ষক হোস্টেল এখন সীতাকুণ্ড এসি ল্যান্ডের বিলাস ভবন, ফার্নিচার ধ্বংস

সরকারি মহিলা শিক্ষক হোস্টেল এখন সীতাকুণ্ড এসি ল্যান্ডের বিলাস ভবন, ফার্নিচার ধ্বংস
সরকারি মহিলা শিক্ষক হোস্টেল এখন সীতাকুণ্ড এসি ল্যান্ডের বিলাস ভবন, ফার্নিচার ধ্বংস

পোস্টকার্ড ডেস্ক।।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের অর্থায়নে নির্মিত সীতাকুণ্ড উপজেলার একমাত্র সরকারি মহিলা শিক্ষক হোস্টেলটি বিলুপ্ত করে এসিল্যান্ডের বাসভবনে রূপান্তর করা হয়েছে। ভবনটিতে এখন শিক্ষিকাদের পরিবর্তে সস্ত্রীক বসবাস করেন সীতাকুণ্ড সহকারী কমিশনার ভূমি (এসিল্যান্ড) মো. আশরাফুল আলম।

তাছাড়া বাসা ভাড়া পরিশোধ না করে পরিবার নিয়ে বসবাস করছেন এসিল্যান্ড। সরকারি নিয়মে বাসা ভাড়া প্রতিমাসে কর্মকর্তাদের মোট বেতন থেকে কর্তণ হয়। কিন্তুু এসিল্যান্ড আশরাফুল আলম তার নামে কোন বাসা বরাদ্দ নেননি। এ তথ্য একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্র নিশ্চিত করেছে। ফলে মোট বেতন থেকে তার বাসা ভাড়াও কর্তণ হচ্ছে না।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, এই দ্বিতল ভবনের ভেতরে বাইরে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটিয়ে মহিলা শিক্ষক হোস্টেলের সকল চিহ্ন মুছে দেয়া হয়েছে। সরিয়ে ফেলা হয়েছে নির্মাণকালীন স্থাপিত ‘মহিলা শিক্ষক হোস্টেল’ লেখা ফলকটিও। বাইরে ফেলে দেয়া হয়েছে শিক্ষিকাদের জন্য সরকারি বরাদ্দের লাখ লাখ টাকার ফার্নিচার।

তাছাড়া অভিযোগ ওঠেছে বিল্ডিংটি রক্ষণাবেক্ষণের নামে বিলাসী ফার্নিচার সংযোজন করে সরকারি কোষাগারের প্রায় ১৫ লক্ষ টাকা অপচয় করা হয়েছে ।

এদিকে উপজেলায় মহিলা শিক্ষকদের আবাসন সংকটের কারণ খুঁজতে গিয়ে জানা যায়, শিক্ষকতা পেশায় নারীদের পথ সুগম করার লক্ষ্যে গ্রামীণ পরিবেশে আবাসন সুবিধা ও নিরাপত্তা নিশ্চিতে সরকারিভাবে গ্রহণ করা হয় ‘প্রমোট কর্মসূচি’। এ কর্মসূচির আওতায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের অর্থায়নে ২০০৫ সালে সারাদেশের দুই শতাধিক উপজেলায় মহিলা শিক্ষক হোস্টেল নির্মাণ করা হয়।

এরই প্রেক্ষিতে সীতাকুণ্ড উপজেলা পরিষদের অভ্যন্তরে অবস্থিত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সম্মুখে নির্মাণ করা হয় উপজেলার একমাত্র মহিলা শিক্ষক হোস্টেলটি। দ্বিতল বিশিষ্ট হোস্টেলের প্রতি তলায় রয়েছে তিনটি করে কক্ষ। প্রতিটি কক্ষের সাথে সংযুক্ত রয়েছে গোসলখানা। প্রতি তলায় রয়েছে বসার ঘর, সংযুক্ত খাবার ঘর ও ১টি করে রান্নাঘর। অর্থাৎ দুই তলা মিলে রয়েছে মোট ৬টি কক্ষ।

নিয়মানুযায়ী, প্রতি কক্ষে দুজন করে ছয়টি কক্ষে মোট ১২ জনের আবাসনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রত্যেক শিক্ষককে আবাসনের জন্য মাসিক ভিত্তিতে ভাড়া দিতে হবে ২০০ টাকা এবং অন্যান্য সুবিধাদির খরচ ১০০ টাকাসহ মোট ৩০০ টাকা। প্রমোট নির্দেশিকায় হোস্টেলগুলোতে মহিলা শিক্ষকদের আবাসনে উৎসাহিত করার জন্য হোস্টেল ব্যবস্থাপনা কমিটিকে পরামর্শ দেয়া হয়েছে।

নির্দেশিকা অনুযায়ী, হোস্টেলটির ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতির দায়িত্বে থাকবেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও সদস্য সচিব উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা। মহিলা শিক্ষকদের হোস্টেলে থাকতে উৎসাহিত করা ও জেলাব্যাপী প্রচারের দায়িত্ব সভাপতির বলে নির্দেশিকায় উল্লেখ করা হয়েছে। সে হিসেবে সীতাকুণ্ড উপজেলা মহিলা শিক্ষক হোস্টেল ব্যবস্থাপনা কমিটির বর্তমানে সভাপতির দায়িত্বে রয়েছেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মো. শাহাদাত হোসেন।

কিন্তু অবিশ্বাস্যভাবে প্রধান দায়িত্বে থাকা ইউএনও শাহাদাত হোসেন হোস্টেলটি রক্ষণাবেক্ষণ না করে উল্টো বিলুপ্তি ঘটিয়েছেন। তার দাবি, হোস্টেলের প্রকল্প শেষ; তাই আর মহিলা হোস্টেলের প্রয়োজনীয়তা সীতাকুণ্ডে নেই।

জানা যায়, এসিল্যান্ড আশরাফুল আলম ২০২১ সালের ১৬ আগস্ট সীতাকুণ্ডে যোগদানের পর উপজেলার অভ্যন্তরের সরকারি আবাসিক ভবনগুলো পুরনো দেখে কোন বাসা বরাদ্দ নেননি। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে উপজেলার আবাসিক অন্য সব ভবনের চেয়ে অধিকতর নতুন, উন্নত ও ভিন্ন আঙ্গিকে তৈরি মহিলা শিক্ষক হোস্টেলটি তার নজরে আসে। পরবর্তীতে পরিবার নিয়ে বসবাসের জন্য সেটিকেই পছন্দ করে বিষয়টি ইউএনও শাহাদাত হোসেনকে জানান তিনি। এরপর ইউএনও মো. শাহাদাত হোসেন উপজেলার একমাত্র সরকারি মহিলা হোস্টেলটিকে এসিল্যান্ডের বাসবভনে রূপান্তরিত করতে প্রমোট  নীতিমালা উপেক্ষা করেন।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, এসিল্যান্ডের সাথে কেবল সুসম্পর্কের কারনেই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ইউএনও শাহাদাত হোসেন।  অসহায় মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা প্রমোট নির্দেশিকা অনুযায়ী মাধ্যমিক, প্রাথমিক, মহাবিদ্যালয় এবং কিন্ডার গার্টেনের নারী শিক্ষকরা এই হোস্টেলের কক্ষ ভাড়া নিতে পারবেন। প্রতি মাসে সর্বোচ্চ ১২ জন শিক্ষক ভাড়া বাবদ জনপ্রতি ৩শ’ টাকা করে তিন হাজার ছয়শত টাকা প্রদান করবেন। ভাড়া বাবদ প্রাপ্ত অর্থ মহিলা শিক্ষক হোস্টেলের নাম এবং ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি ও সদস্যসচিব পরিচালিত ব্যাংক হিসাবে জমা হবে। যা হোস্টেলে বসবাসরতদের মধ্য থেকে একজন প্রতিনিধি জমা দেবেন। সে অনুযায়ী, সীতাকুণ্ড উপজেলার এ মহিলা হোস্টেলটির নামে জনতা ব্যাংকে একটি হিসাব খোলা রয়েছে। হোস্টেলটি চালুর পর থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসে ভাড়া আদায় সংক্রান্ত হিসাব-নিকাশ, বসবাসকারীদের তালিকা, বরাদ্দ, নির্দেশিকা ইত্যাদি সংরক্ষণ করা হয়ে থাকে।  গত ২১ নভেম্বর উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসারের দফতরে এ প্রতিবেদককে এসব তথ্য জানিয়েছেন সীতাকুণ্ড উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা এস মোস্তফা আলম সরকার গুড্ডু। এসময় তিনি প্রমোট নির্দেশিকা বইটি দেখিয়ে বলেন, মহিলা শিক্ষক হোস্টেল নির্মাণের উদ্দেশ্য, পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের বিস্তারিত নীতিমালা এ বইতে লিপিবদ্ধ আছে। কিন্তু এরপরও ইউএনও হচ্ছেন এ হোস্টেল ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি এবং উপজেলার সর্বেসর্বা। হোস্টেলটি আবাসিক ভবন হবে এবং এতে এসিল্যান্ড বসবাস করবেন এ সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করার সুযোগ আমার নেই। এ ক্ষেত্রে নিজের অসহায়ত্বের কথা তুলে ধরেন তিনি।

এসময় তিনি আক্ষেপ করে বলেন, এটি সত্য যে উপজেলায় মহিলা শিক্ষিকাদের আবাসন সংকটে রয়েছে। বিশেষ করে এনটিআরসিএ কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত অনেক শিক্ষিকা শুধুমাত্র আবাসন সংকটের কারণে সীতাকুণ্ডে যোগদান করতে অনীহা প্রকাশ করেন। 

মুছে দেয়া হয়েছে জাতীয় পতাকা, নারী শক্তির প্রতীক ।

সারাদেশে প্রমোট কর্মসূচির আওতায় নির্মিত দুই শতাধিক উপজেলায় মহিলা শিক্ষক হোস্টেল ভবনগুলোকে প্রমোট বিল্ডিং (ভবন) নামে নামকরণ করা হয়েছে। সর্বাধুনিক সিরামিক ইটের গাঁথুনি দিয়ে নির্মিত এ ভবনের বাইরের দেয়ালে সিমেন্টের আস্তরণ বা রং করার নিয়ম নেই। বরং সারি সারি ইটের গাঁথুনি প্রমোট ভবনটিকে অন্য এক ভিন্নতা এনে দিয়েছে। মাত্র ১৬ বছর আগে নির্মিত এ ভবনটি সীতাকুণ্ড উপজেলার সকল আবাসিক ভবনের তুলনায় অত্যধিক নতুন, উন্নতও বটে।  কিন্তু এ প্রমোট বিল্ডিংটিকে এসিল্যান্ডের বাসবভনে রূপ দিতে এর বাইরের দেয়াল গাড় লাল রং দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়েছে। সরিয়ে ফেলা হয়েছে বিল্ডিংয়ের দেয়ালে স্থায়ীভাবে লাগানো বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা, ইউরোপীয় ইউনিয়নের পতাকা, নারী শক্তির প্রতীক, উদ্বোধনকালীন ব্যক্তির নাম ও বিল্ডিং নির্মাণের তারিখ লেখা নাম ফলকটিও।

এসিল্যান্ডের বাসভবনে রূপান্তর

মহিলা শিক্ষক হোস্টেলটিকে এসিল্যান্ডের বাসভবনে রূপ দিতে কেবল বাইরের দৃশ্য বদলানোতেই শেষ নয়। ভবন অভ্যন্তরে আনা হয়েছে ব্যাপক পরিবর্তন। এমনকি ভবনটিকে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ উপযোগী করতে ভবন নির্মাণকালীন জানালাগুলো সরিয়ে সেখানে গ্লাস বসানো হয়েছে। ভবনের বাইরের দেয়ালে বসানো হয়েছে শীতাতপ যন্ত্র।

নির্মাণকালীন আস্তরণ উঠিয়ে ভবনের ফ্লোরজুড়ে বসানো হয়েছে অত্যাধুনিক টাইলস। বাথরুমে হাই কমোড, উন্নত ফিটিংস, এসি ও ইলেকট্রনিক্স সামগ্রী।

এছাড়া ভবনের ছাদে বসানো হয়েছে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক লেখা সম্বলিত ও ছাতাযুক্ত এক জোড়া স্লিপিং চেয়ার। যা সীতাকুণ্ডের গুলিয়াখালী সমূদ্র সৈকতকে সরকারি পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে ঘোষণা উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে দেখা গিয়েছিল।

এসব কারণে সারাদেশে বিদ্যমান প্রমোট বিল্ডিংসমূহের সাথে সীতাকুণ্ডের এই ভবনের ন্যূনতম দৃশ্যমান মিল খুঁজে পাওয়া যাবে না। বরং এখন এটি উপজেলা অভ্যন্তরের অন্য আবাসিক ভবনের মতই একটি লাল ভবন।

সরকারি কোষাগারের অপব্যবহার, অপচয়

প্রমোট নীতিমালায় উল্লেখ করা হয়েছে, এক বছরে ভবনটি সংস্কারের ব্যয়ের পরিসীমা হবে ১০ হাজার টাকা। প্রয়োজনভেদে ১০ হাজার টাকার বেশি খরচ করতে হলে জেলা মহিলা শিক্ষক হোস্টেলের সভাপতির কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে। যা নারী শিক্ষকদের মাসিক ভিত্তিতে প্রদেয় ভাড়া থেকে উত্তোলন করা হবে। এছাড়া করোনা পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবেলা ও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা পরিস্থিতি সামাল দিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কম গুরুত্বপূর্ণ প্রজেক্ট হাতে নিতে নিরুৎসাহিত করেছেন। অথচ গুরুত্বপূর্ণ কিংবা কমগুরুত্বপূর্ণ কোনও আওতাতেই পড়ে না প্রমোট ভবনের এমন ব্যয়বহুল সংস্কার।

এরপরও কেবল এসিল্যান্ডের উচ্চবিলাসী চাহিদা মেটাতে উপজেলা এলজিআরডি দপ্তর থেকে প্রমোট ভবন রক্ষণাবেক্ষণ প্রকল্পের নামে ১৫ লক্ষ টাকার বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। আরএফকিউ টেন্ডারের মাধ্যমে উক্ত কাজ পাওয়া ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের এক শ্রমিক জানিয়েছেন, সংস্কার কাজ করার সময় এসিল্যান্ড আশরাফুল আলম মাঝেমধ্যে আসতেন এবং নিজের পছন্দসই এটা সেটা দেখিয়ে দিতেন। তবে আশরাফুল আলম এসব অস্বীকার করেছেন।

এদিকে, উপজেলায় নিয়োগপ্রাপ্ত একজন এসিল্যান্ডের সরকারি বেতন স্কেল অনুযায়ী, মূল বেতন, মূল বেতনের ওপর ৪০ শতাংশ বাসা ভাড়া ও নির্দিষ্ট অংকের চিকিৎসা-ভাতা যোগ হয়ে সর্বমোট বেতন নির্ধারিত হয়। সরকারি বরাদ্দকৃত বাসায় থাকলে প্রতি মাসে ৪০ শতাংশ টাকা বাসা ভাড়া বাবদ কেটে রেখে অবশিষ্ট টাকা মোট বেতন হিসাবে প্রদান করা হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে এসিল্যান্ড আশরাফুল আলম উপজেলা কম্পাউন্ডের অভ্যন্তরে সস্ত্রীক বসবাস করলেও তার নামে কোন বাসা বরাদ্দ নেয়া হয়নি। ফলে তার বাসা ভাড়া বাবদ বেতনের ৪০ শতাংশ টাকা সরকারের রাজস্ব খাতে যুক্ত হচ্ছে না।

এ প্রসঙ্গে এসিল্যান্ড আশরাফুল আলম বলেন, ‘যেহেতু আমার বাসা উপজেলা পরিষদের কম্পাউন্ডের অভ্যন্তরে। এটি উপজেলা পরিষদের নিজস্ব স্থাপনা হিসেবে গণ্য করে এসিল্যান্ডকে বাসা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে উপজেলা কমিটি থেকে। দুইভাবে বাসা ভাড়া পরিশোধের নিয়ম আছে। একটি হচ্ছে একেবারে বছর শেষে আরেকটা হল প্রতি মাসে। বাসা ভাড়া না দিয়ে আমার চলে যাওয়ার সুযোগ নেই। আমি এক সাথেই বাসা ভাড়া পরিশোধ করবো।’

প্রমোট নির্দেশিকা মানেননি ইউএনও

উপজেলা পরিষদের অভ্যন্তরে মহিলা শিক্ষক হোস্টেল থাকার কথা শুনলে উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. শাহাদাত হোসেন তা এডিয়ে জান। হোস্টেলের জন্য নির্মিত প্রমোট ভবনটি পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে নির্ধারিত প্রমোট নীতিমালা মানতেও নারাজ তিনি। তার সাফ কথা ‘প্রকল্প শেষ আরও এক যুগ আগে।’ কিন্তু প্রকল্প শেষ এ কথার ব্যাখ্যা কী জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মহিলা শিক্ষকরা আসেন না তাই এ প্রকল্পের প্রয়োজনীয়তা শেষ। এটি এখন পরিত্যক্ত, গুদাম। আর পরিত্যক্ত একটি ভবনকে বাসযোগ্য করেছি এজন্য আমাকে বাহবা দেয়া উচিত।’

কিন্তু হোস্টেল ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি হিসেবে প্রমোট নীতিমালা অনুযায়ী শিক্ষিকাদেরকে হোস্টেলে থাকতে উৎসাহ দেয়া ও প্রচার করার দায়িত্ব ইউএনও’র। এমন কথা স্মরণ করিয়ে দিলে ইউএনও বলেন, ‘সেসব অনেক আগের কথা। এখন এক উপজেলা থেকে অন্য উপজেলায় শিক্ষিকারা বদলি হন না। সুতরাং হোস্টেলেরও প্রয়োজনীয়তা নেই।’

অথচ মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার জানিয়েছেন, এখনও প্রাইমারি পর্যায়ে শিক্ষকরা বদলি হন। বিশেষ করে এনটিআরসিএ’র মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকরা শুরুতে নিজ উপজেলায় না হলে পার্শ্ববর্তী উপজেলা বা অন্য জেলায়ও পদায়িত হয়ে থাকেন। এছাড়া সীতাকুণ্ড উপজেলার পরিধিও ছোট নয়। দূর-দূরান্তের শিক্ষকদেরও এখানে বসবাসের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়।

অন্যদিকে একাধিক নারী শিক্ষক জানিয়েছেন, ২০১৮ সাল পর্যন্ত তারা মহিলা শিক্ষক হোস্টেলে ৩শ’ টাকা ভাড়ায় বসবাস করেছেন।

লাখ লাখ টাকার সরকারি ফার্নিচার ধ্বংস

সাধারণত সরকারি বরাদ্দের ফার্নিচার বেসরকারি ফার্নিচারের চেয়ে অধিক উন্নত ও টেকসই হয়ে থাকে। কিন্তু মহিলা শিক্ষক হোস্টেলে থাকা ১২টি খাট, দুই সেট সোফা, দুই সেট ডাইনিং টেবিল চেয়ার, ১২ জন শিক্ষকের প্রত্যেকের জন্য নির্ধারিত টেবিল-চেয়ার ও ওয়্যারড্রোবসহ লাখ লাখ টাকার ফার্নিচার বাইরে ফেলে দেওয়া হয়েছে। ইউএনও’র মতে, ফার্নিচারগুলো অকেজো তাই ফেলে দেয়া হয়েছে।

কিন্তু খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, ফেলে দেয়া ফার্নিচারগুলো ছিলো মজবুত ও বছরের পর বছর ব্যবহারের উপযোগী। যেগুলোর মধ্যে এক সেট সোফা এখনও ব্যবহার করা হচ্ছে মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসের ওয়েটিংরুমে। সেখানকার কর্মচারীরা জানিয়েছেন, ফার্নিচারগুলো তারা কুড়িয়ে দপ্তরে এনেছেন এবং কয়েকটি চেয়ার কুড়িয়ে নিয়েছে উপজেলা কৃষি অফিস।

তাদের তথ্যমতে, সেসব দেখে সরকারি বরাদ্দের ফার্নিচারের উন্নত মান ও স্থায়িত্ব সহজেই অনুমান করা যায়। বাকি ফার্নিচার বাইরে ফেলে দেয়ায় অযত্নে-অবহেলায় বৃষ্টিতে ভিজে নষ্ট হয়ে গেছে।

আবাসন সংকটে মহিলা শিক্ষকরা

এদিকে সরকারি মহিলা শিক্ষক হোস্টেল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অনেক শিক্ষিকাকে আবাসন সংকটে ভুগতে হচ্ছে। অতিরিক্ত অর্থে অন্যত্র বাসা ভাড়ায় থাকতে হচ্ছে তাদের। ফলে খরচ মেটাতে যেমন হিমশিম খেতে হচ্ছে। তেমনি বাসা বদলের ঝক্কি-ঝামেলা, নিরাপত্তাহীনতা, বিদ্যালয়ে যাতায়াতে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে ব্যাচেলর শিক্ষিকাদের।

এসব বিষয়ে কথা হয় উপজেলার বেশ কয়েকজন মহিলা শিক্ষকের সঙ্গে। যারা এ নিয়ে ব্যক্ত করেছেন ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া। তবে বিপদের আশঙ্কায় তারা নিজেদের নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষিকা বলেন, ‘আমার গ্রামের বাড়ি দেশের উত্তরাঞ্চলে। আমি সীতাকুণ্ডে বদলি হওয়ার পর ইউএনও বরাবর শিক্ষিকা হোস্টেলে থাকার আবেদন করি। বারবার সিট বরাদ্দ দেয়ার আশ্বাস দিলেও এখনও দেয়া হয়নি৷ আমি ভাড়া বাসায় আছি।’

ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বলেন, ‘ভবনটি যে মহিলা শিক্ষকদের হোস্টেল সেটি উপজেলার কর্মকর্তারা প্রচার করতে নারাজ। পুরো চাকরিজীবনে ওই ভবনকে হোস্টেল হিসেবে দেখে আসলেও এখন শুনছি এসিল্যান্ডের বাসভবন। উপজেলার কোনও মহিলা শিক্ষক সেখানে থাকার সুযোগ পান না। তারা নিজেদের দখলে রেখেছেন সেটি।’

নাম প্রকাশ না করে আরেক শিক্ষিকা বলেন, ‘রাতারাতি মহিলা শিক্ষক হোস্টেলকে এসিল্যান্ডের বাসভবন করা হয়েছে। সেখানে হোস্টেলের কোনও চিহ্নও রাখা হয়নি। এতো পরিবর্তন করা হয়েছে যে, সেটি যে মহিলা শিক্ষক হোস্টেল তা দেখলে আঁচ করা সম্ভব নয়।’

আবেদন করেও হোস্টেলে থাকার সুযোগ না পাওয়া আরেকজন শিক্ষিকা বলেন, ‘মহিলা শিক্ষক হোস্টেলে থাকতে মাত্র ৩শ’ টাকা পরিশোধ করতে হতো। ফলে একজন শিক্ষক অনায়াসেই আবাসন ব্যয় মিটাতে সক্ষম হতেন। বর্তমানে এ হোস্টেলে থাকার সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন শিক্ষিকারা। তাছাড়া সীতাকুণ্ডে ব্যাচেলর হিসেবে ভাড়া বাসা পাওয়া দুস্কর বলে বেশি দামে ফ্যামিলি বাসা ভাড়া নিতে হয়। নিরাপত্তাহীনতার বিষয়টি তো আছেই।’

উপজেলার একজন ( নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) কর্মচারি বলেন, ‘মহিলা শিক্ষক হোস্টেলকে এসিল্যান্ডের বাসভবনে রূপান্তর করার সময় মুখে কুলুপ এঁটেছিলেন মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার। তিনি একবারও শিক্ষকদের কথা ভাবেননি। বরং নারীবিরোধী সিদ্ধান্তে তিনি সম্মতি দিয়েছেন। এর পেছনে তার ব্যর্থতা রয়েছে।’

আরেকজন সরকারি কর্মচারি বলেন, ‘মহিলা শিক্ষক হোস্টেলের নিয়ন্ত্রণ আগে মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসের ছিলো। তখন প্রতিবছরের জানুয়ারিতে শিক্ষার্থীদের জন্য আসা লাখ লাখ নতুন বই হোস্টেলের অব্যবহৃত একটি কক্ষে সংরক্ষণ করা যেত। এখন স্থানের অভাবে বই নষ্ট হচ্ছে।’

জানতে চাইলে চট্টগ্রাম জেলা শিক্ষা অফিসার ফরিদুল আলম হোসাইনী বলেন, উপজেলা মহিলা শিক্ষক হোস্টেলের সাথে জেলা শিক্ষা অফিসারের সংশ্লিষ্টতা বা দায়িত্ব আছে কিনা সেটি তার জানা নেই বলে জানান।

এ বিষয়ে চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) আবু রায়হান দোলন বলেন, মহিলা শিক্ষক হোস্টেল সম্পর্কে আমার ধারণা নেই। আমি এ সম্পর্কে জানি না। 

খালেদ / পোস্টকার্ড ;