নেতা নির্বাচন করব আমি, তোমরা তৃণমূলের সম্মেলন শেষ করো : প্রধানমন্ত্রী  

নেতা নির্বাচন করব আমি, তোমরা তৃণমূলের সম্মেলন শেষ করো : প্রধানমন্ত্রী  
নেতা নির্বাচন করব আমি। তোমরা তৃণমূলের সম্মেলন শেষ করো : প্রধানমন্ত্রী  

পোস্টকার্ড ডেস্ক ।।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের বিভিন্ন ওয়ার্ড ও ইউনিটের সম্মেলন দ্রুততম সময়ের মধ্যে শেষ করার তাগাদা দিয়ে বলেছেন, নেতা নির্বাচন করব আমি। তোমরা তৃণমূলের সম্মেলন শেষ করো। 

রোববার চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ দলের সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে গণভবনে সাক্ষাৎ করতে গেলে এ সময় পরস্পরের বিরুদ্ধে অভিযোগ ও পাল্টা অভিযোগ করেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রী নিজেই নেতা নির্বাচন করবেন বলে নেতৃবৃন্দকে আশ্বস্ত করেন। দুই ঘণ্টার বেশি সময় ধরে চলা বৈঠকে সামনে নির্বাচন উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী সবাইকে মিলেমিশে কাজ করার আহ্বান জানান। 

গণভবনে বৈঠকে অংশ নেয়া নেতারা জানিয়েছেন, মহানগর আওয়ামী লীগের সার্বিক অবস্থা দলীয় প্রধানকে জানানোর জন্য বেশ কিছুদিন ধরে সুযোগ খুঁজছিলেন নেতৃবৃন্দ। অবশেষে গতকাল গণভবনে যাওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর ডাক পান মহানগরের নেতৃবৃন্দ। এরপর তারা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যান। অভিযোগ ও পাল্টা অভিযোগ ধৈর্য ধরে শোনার পর দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনা নগর আওয়ামী লীগের ওয়ার্ড ও থানার সম্মেলন সম্পন্ন করার নির্দেশ দিয়েছেন বলে নেতারা জানিয়েছেন।

নগর আওয়ামী লীগের নেতারা গতকাল সকাল সাড়ে ১১টার দিকে গণভবনে যান। ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীনের নেতৃত্বে তাদের অনুসারীরা একসঙ্গে গণভবনে প্রবেশ করেন। এ সময় সহসভাপতি নঈম উদ্দিন, সাংগঠনিক সম্পাদক নোমান আল মাহমুদ, স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক ফয়সল ইকবাল চৌধুরী, সদস্য বিজয় কিষাণ চৌধুরী, বেলাল উদ্দিনসহ কয়েকজন গণভবনে যান।

অন্যদিকে মাহতাব–নাছির বিরোধী হিসেবে পরিচিতরা নগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি অ্যাডভোকেট ইব্রাহিম হোসেন চৌধুরী বাবুল, খোরশেদ আলম সুজন, সিডিএ চেয়ারম্যান জহিরুল আলম দোভাষ, আলতাফ হোসেন চৌধুরী, সিনিয়র যুগ্ম সম্পাদক সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী, কোষাধ্যক্ষ আবদুচ ছালামসহ কয়েকজন আলাদাভাবে গনভবনে প্রবেশ করেন।

সহসভাপতি অ্যাডভোকেট ইব্রাহিম হোসেন চৌধুরী বাবুল বলেন, সকাল সাড়ে ১১টার দিকে নগর আওয়ামী লীগের নেতারা গণভবনে প্রবেশ করেন। বেলা দেড়টার দিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বৈঠকে বসেন। প্রায় দুই ঘণ্টা বৈঠক চলে। বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে বৈঠক সম্পন্ন হয়। বৈঠকে সাংগঠনিক নানা বিষয় নেত্রীর সামনে তুলে ধরা হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা নগর আওয়ামী লীগের সার্বিক পরিস্থিতি নেত্রীকে বলতে গিয়েছিলাম। তিনি ধৈর্য ধরে আমাদের কথা শুনেছেন।

বৈঠকে অংশগ্রহণকারী এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, নগর আওয়ামী লীগের ভিতরে যা হচ্ছে তা নেত্রীকে জানানো হয়েছে। নেত্রীর সামনে পুরো বিষয়টি স্পষ্ট করা হয়েছে। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সম্মেলন হয়েছে গত বছরের ২৪ ডিসেম্বর। এর আগে মহানগর আওয়ামী লীগের সম্মেলন করার নির্দেশনা থাকলেও কয়েক দফা সময় ঘোষণা করেও শেষ পর্যন্ত হয়নি। এমনকি ওয়ার্ড–থানার সম্মেলনও সম্পন্ন হয়নি। শুধুমাত্র ইউনিট সম্মেলনগুলো সম্পন্ন হয়। নগর আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দের বিরোধের কারণেই সম্মেলন করা সম্ভব হয়নি। গতকাল গণভবনে যোগ দেয়া মাহতাব–নাছির বিরোধীদের অভিযোগ, নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের অনীহার কারণেই মূলত কেন্দ্রীয় সম্মেলনের আগে মহানগর আওয়ামী লীগের সম্মেলন সম্পন্ন করা যায়নি।

গণভবনের বৈঠকে যোগ দেয়া মাহতাব–নাছিরের বিরোধীরা সভানেত্রী শেখ হাসিনার কাছে সম্মেলন না হওয়ার জন্য ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদককে দায়ী করেন। তারা অভিযোগ করেন, ইউনিট কমিটিগুলো সাংগঠনিক বিধিবিধান ও গঠনতন্ত্র উপেক্ষা করে একতরফাভাবে করা হয়েছে।

কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠকে সম্মেলন নিয়ে যেসব সিদ্ধান্ত হয়েছিল মাহতাব–নাছিরের বাধায় সেগুলো বাস্তবায়ন হয়নি। ওয়ার্ড ও থানা কমিটির সম্মেলনও তারা একতরফাভাবে করে ফেলতে চাচ্ছেন বলেও নেত্রীর কাছে অভিযোগ করেন।

মাহতাব–নাছির বিরোধী শিবিরের নেতৃবৃন্দ প্রথমে নগর আওয়ামী লীগের সম্মেলন শেষ করে নতুন নেতৃত্বের তত্ত্বাবধানে ওয়ার্ড এবং থানা সম্মেলন করার দাবি জানান। এই সময় আ জ ম নাছির উদ্দীন কাদের কারণে সম্মেলন করা সম্ভব হয়নি তা নেত্রীর সামনে উপস্থাপন করেন।

বৈঠকে অংশ নেওয়া একাধিক নেতার সঙ্গে গতকাল টেলিফোনে কথা বলে জানা গেছে, বৈঠক চলাকালে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ উত্থাপনের সময় নগর আওয়ামী লীগের নেতাদের মাঝে কয়েক দফা বাকবিতণ্ডা ও উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় হয়। দলীয় প্রধান হস্তক্ষেপ করে দুই গ্রুপকে শান্ত করেন।

বৈঠকের ব্যাপারে জানতে চাইলে নগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি খোরশেদ আলম সুজন আজাদীকে বলেন, বৈঠক হয়েছে। নেত্রীর সাথে আমরা কথা বলেছি। আমরা বলেছি যে, ওয়ার্ড সম্মেলন হবে থানা কমিটির অধীনে। কিন্তু বেশ কয়েকটি থানায় তো স্ট্রাকচারই ঠিক নেই। তারা সম্মেলন করবে কিভাবে?

সেজন্য আমরা আগে নগর কমিটির সম্মেলন করার প্রস্তাব দিয়েছিলাম। নেত্রী সবকিছু শুনেছেন। তিনি সাংগঠনিক ধারাবাহিকতা রক্ষায় আগে তৃণমূলের সম্মেলন শেষ করতে বলেছেন। তিনি বলেছেন, আমি নেতা ঠিক করব।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সব ধরনের বিরোধ ভুলে দলীয় নেতৃবৃন্দকে একযোগে কাজ করার নির্দেশনা দিয়েছেন। সামনে নির্বাচন আসছে। নির্বাচনকে সামনে রেখে তৃণমূল পর্যায়ে দলকে শক্তিশালী এবং সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি করারও পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। আগামী নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত হওয়ার জন্যও তিনি দলীয়

নেতাদের আহ্বান জানান। ওয়ার্ড এবং থানার সম্মেলনে দলীয় ত্যাগী নেতাকর্মীদের মূল্যায়ন করারও নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। ওয়ার্ড এবং থানা পর্যায়ের সম্মেলনের পর নগর আওয়ামী লীগের সম্মেলন করার পরামর্শ দিয়েছেন দলীয় প্রধান। তিনি বলেন, আগে তৃণমূলের নেতৃত্ব ঠিক হোক। পরে আমিই নেতা ঠিক করব।

গণভবনের বৈঠকে যোগ দেয়া নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীন বলেছেন, অনেকদিন পর নেত্রীর সামনে সাংগঠনিক বিষয়ে একেবারে খোলাখুলি আলাপ করেছি। সাংগঠনিক নানা প্রসঙ্গের মধ্যে সম্মেলনের প্রসঙ্গও এসেছে। নেত্রী আগামী নির্বাচনের প্রস্তুতি নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।

তিনি বলেছেন, ষড়যন্ত্র আগেও হয়েছে, এখনো হচ্ছে। সতর্ক থাকতে হবে। দলের এত অর্জন, এত উন্নয়ন এবং এত সফলতার কথা সাধারণ মানুষকে বোঝাতে হবে। তৃণমূল পর্যায়ে কর্মী সংখ্যা বাড়ানোর পরামর্শ দিয়ে নেত্রী বলেছেন, যত বেশি কর্মী সৃষ্টি করা যাবে নির্বাচনে তার একটি ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। নেত্রী আমাদেরকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করারও নির্দেশনা দিয়েছেন।

বাকবিতণ্ডা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর সামনে কোনো বাকবিতণ্ডা হয়নি। প্রধানমন্ত্রীর সামনে উনারা উনাদের কথা বলেছেন, আমরা আমাদের বিষয় বলেছি। নেত্রী আমার যে প্রস্তাব অর্থাৎ আগে ওয়ার্ড ও থানার সম্মেলন, এরপর নগরের সম্মেলন, সেটির বিষয়ে সম্মতি দিয়েছেন।

উল্লেখ্য, ২০২১ সালের শেষ দিকে নগর আওয়ামী লীগের তৃণমূলের সম্মেলন শুরু হলে নেতাদের মধ্যে বিরোধ তুঙ্গে ওঠে। নগর আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েন। ওই বছরের ১৬ নভেম্বর থেকে নগরীর ৪৪টি সাংগঠনিক ওয়ার্ডে ইউনিট সম্মেলন শুরু করে নগর আওয়ামী লীগ। সেই সম্মেলন নিয়ে সংঘাত ও বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ ওঠার পর ওই বছরের ২৩ ডিসেম্বর কেন্দ্র থেকে দেয়া এক নির্দেশে ওয়ার্ড সম্মেলন বন্ধ রাখা হয়।

ইউনিট সম্মেলন নিয়ে বিরোধ নিরসনে ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে কেন্দ্র থেকে রিভিউ কমিটি গঠন করে দেওয়া হয়েছিল। রিভিউ কমিটি কেন্দ্রের অনুমতিক্রমে ১৫ সাংগঠনিক থানার জন্য নগর আওয়ামী লীগের একজন করে নেতাকে দায়িত্ব দিয়ে ১৫টি সাংগঠনিক টিম গঠন করে। তাদের ইউনিট সম্মেলন নিয়ে অভিযোগ যাচাই–বাছাইপূর্বক দ্বন্দ্ব–সংঘাত নিরসন করে ঐক্যবদ্ধভাবে তৃণমূলের সম্মেলন সম্পন্ন করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু বিরোধ মেটেনি। ফলে ইউনিট সম্মেলন শেষ হলেও ওয়ার্ড ও থানাগুলো ঝুলে আছে।

২০০৫ সালে সর্বশেষ মহানগর আওয়ামী লীগের সম্মেলন হয়েছিল। এতে সভাপতি–সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী ও কাজী ইনামুল হক দানু। দানু মারা যাওয়ার পর ২০১৩ সালে কেন্দ্র থেকে একটি কমিটি ঘোষণা করা হয়, যাতে মহিউদ্দিনকে সভাপতি ও আ জ ম নাছির উদ্দীনকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়। ২০১৭ সালের ১৫ ডিসেম্বর মহিউদ্দিনের মৃত্যুর পর প্রথম সহসভাপতি মাহতাব উদ্দীন চৌধুরীকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব দেওয়া হয়।- আজাদী 

খালেদ / পোস্টকার্ড ;