নানামুখী সঙ্কটাবর্তে সীতাকুণ্ডবাসী, দেখার যেন কেউ নেই 

নানামুখী সঙ্কটাবর্তে সীতাকুণ্ডবাসী, দেখার যেন কেউ নেই 
নানামুখী সঙ্কটাবর্তে সীতাকুণ্ডবাসী, দেখার যেন কেউ নেই 

পোস্টকার্ড ডেস্ক ।। 

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড নানামুখী সঙ্কটাবর্তে এখন । উপজেলার ভাগ্যাহত মানুষগুলো বেকারত্ব, সেচসঙ্কট, জলাবদ্ধতাসহ বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত । তাছাড়া বেড়িবাঁধ না থাকাটাই এখানের প্রধানতম সমস্যা। জীবন-মরণ সমস্যা বললেও অত্যুক্তি হয় না। কেননা, বেড়িবাঁধ মানে প্রাণরক্ষা বাঁধ। কিন্তু এসব দেখার যেন কেউ নেই। 

আবহমানকাল থেকে সীতাকুণ্ডের উপকূলীয় জনসাধারণ বেড়িবাঁধ-সমস্যার বেড়াজালে আটকে থাকলেও এর কোনো সমাধানের আলামত নেই। অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে, এ সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব যাদের তারা নাকে তেল দিয়ে ঘুমোচ্ছেন।

বেড়িবাঁধ না থাকায় সন্দ্বীপ-চ্যানেলের অব্যাহত ভাঙ্গনে শিল্পাঞ্চল সীতাকুণ্ডের সলিমপুর, ভাটিয়ারি, সোনাইছড়ি, কুমিরা ও বাঁশবাড়িয়া ইউনিয়নের বিস্তীর্ণ এলাকা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। ধ্বংস হয়ে গেছে কোটি কোটি টাকার সম্পদ। বাস্তুহারা হয়েছে কয়েক হাজার পরিবার। বেড়িবাঁধ না থাকায় আতঙ্কে দিন কাটে সমুদ্র উপকূলীয় বাসিন্দাদের। দক্ষিণ সীতাকুণ্ডের সমুদ্রোপকূলে চর জাগায় নদীভাঙ্গন বন্ধ হলেও বাঁশবাড়িয়া এলাকায় নদীভাঙ্গন ও জোয়ারের পানির উপদ্রপে জনজীবনে দুগর্তি ও ভোগান্তির শেষ নেই।। বেড়িবাঁধ না থাকায় উপকূলীয় অঞ্চলের ১০ থেকে ১২ কিলোমিটার জনপদ ভেসে যায় জোয়ারের পানিতে। ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের পূর্বাভাস পেলে এ এলাকার মানুষের মানসিক অবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। একানব্বইয়ের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের পরে কুমিরা ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আ ফ ম মফিজুর রহমানকে আহ্বায়ক করে বেড়িবাঁধ বাস্তবায়ন পরিষদ গঠিত হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে এ পরিষদ অজ্ঞাতকারণে ঝিমিয়ে পড়ে। রাজা আসে রাজা যায় কিন্তু জনগণের জানমাল রক্ষার জন্যে অতিপ্রয়োজনীয় বেড়িবাঁধনির্মাণের কোনো উদ্যোগ নেয়া হয় না।

ফৌজদারহাট থেকে কুমিরা পর্যন্ত প্রায় ১৬ কিলোমিটার সমুদ্রোপকূলীয় এলাকার মধ্যে প্রায় আট কিলোমিটার জনপদ বিভিন্ন সময়ে জলোচ্ছ্বাস ও প্রবল জোয়ারে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পাঁচশ’ বর্গকিলোমিটার আয়তনের সীতাকুণ্ড বর্তমানে তিনশ’ বর্গ কিলোমিটারে এসে ঠেকেছে। ৬০, ৬৩, ৭০ সালের ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস পুরো সীতাকুণ্ডকে লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছিল। হাজার হাজার মানুষ সেদিন প্রাণ হারিয়েছিল।

ষাটের দশকের গোড়ার দিকে উত্তর সীতাকুণ্ডের বগাচতর থেকে বাঁশবাড়িয়া পর্যন্ত উপকূলীয় বেড়িবাঁধ নির্মাণের ব্যবস্থা করা হয়। ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস সীতাকুণ্ডের বেড়িবাঁধহীন চারটি ইউনিয়নে প্রচণ্ড আঘাত হেনেছিল। তছনছ করে দিয়েছিল মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাপন। কেড়ে নিয়েছিল সহস্রাধিক মানুষের তাজাপ্রাণ। বিষমভাবে ক্ষতি হয়েছিল ঘরবাড়ি, গবাদিপশু, গাছপালাসহ নানা সহায়-সম্পদের।

অতীতে সব সরকারের আমলে বেড়িবাঁধ নির্মাণের আশ্বাস মিলেছিল। ১৯৯৬ সালের ২৩ আগস্ট তৎকালীন সংসদ সদস্য এ বি এম আবুল কাসেমের উদ্যোগে পানিসম্পদ মন্ত্রী আবদুর রাজ্জাক ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান আবদুস সালাম দক্ষিণ সীতাকুণ্ডের বেড়িবাঁধবিহীন উপকূলীয় ভাঙ্গন-এলাকা পরিদর্শন করেছিলেন। মন্ত্রী সেদিন বেড়িবাঁধ নির্মাণের আশ্বাস দিলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। অতীতে বিভিন্ন সময়ে জনপ্রতিনিধিরা এ ব্যাপারে দেনদেরবার করেও কোনো কুলকিনারা করতে পারেননি।

এদিকে দক্ষিণ সীতাকুণ্ডের সলিমপুর, ভাটিয়ারি, সোনাইছড়ি, দক্ষিণ কুমিরা এলাকায় নদীর তলদেশ ভরাট ও চর জেগে ওঠায় ভাঙ্গন বন্ধ হলেও জোয়ারের পানির জ্বালায় মানুষের জীবনযাত্রা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়। অন্যদিকে বাঁশবাড়িয়া সমুদ্রোপকূলীয় এলাকায় ভাঙ্গন প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকায় উপকূলবাসী মহাবিপদে আছে। সিকদারখাল থেকে আকিলপুর পর্যন্ত বেড়িবাঁধ না থাকায় জোয়ারের পানি বাড়িঘরে ঢুকে শতশত পরিবারের স্বাভাবিক জীবন দুর্বিষহ করে তোলে। জোয়ারের জলে পুরো এলাকা জলমগ্ন হয়ে পড়ে; চাষাবাদে বিঘ্ন ঘটছে। প্রান্তিক জনগোষ্ঠির অভাব নিত্যসঙ্গী হয়ে পড়েছে। বছরখানেক আগে বাঁশবাড়িয়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার আজিজুল হকের উদ্যোগে বেড়িবাঁধ নির্মাণের দাবিতে ভাঙ্গন এলাকায় মানববন্ধন পালন করা হয়েছিল।

অভিযোগ রয়েছে, বেড়িবাঁধ নির্মাণের ক্ষেত্রে শিপব্রেকিং ব্যবসায়ীরা বড় বাধা। শিপব্রেকিং ইয়ার্ড না থাকলে এতদিনে সীতাকুণ্ডের বেড়িবাঁধ নির্মাণ হয়ে যেতো। অতীতে শিপব্রেকিং ব্যবসায়ীরা পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়কে বিভ্রান্ত করেছে। সীতাকুণ্ড বেড়িবাঁধ বাস্তবায়ন পরিষদের আহ্বায়ক আ ফ ম মফিজুর রহমান বলেন, “আমরা বেড়িবাঁধ নির্মাণের জন্যে দেনদরবার করলেও শিপব্রেকিং ব্যবসায়ীরা এর বিরোধিতা করেন। তাদের কথায় বিভ্রান্ত হয়ে ১৯৯৬ সালে পানিসম্পদমন্ত্রী আবদুর রাজ্জাক বলেছিলেন, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক থাকলে বেড়িবাঁধের দরকার নেই।”

যুগের যুগের যুগ বেড়িবাঁধের অভাবে শিল্পাঞ্চল সীতাকুণ্ডের সমুদ্রোপকূলীয় এলাকার লাখলাখ মানুষ এভাবে জোয়ারের পানিতে নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে, ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে ঘটবে প্রাণহানি আর আমাদের জনপ্রতিনিধিদের এ নিয়ে কোনো মাথাব্যথা থাকবে না, তারা বার বার বেড়িবাঁধ নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভোট নিয়ে নিজেদের আখের গোছাবে- তা তো হতে পারে না।

অন্যদিকে সীতাকুণ্ডের উপকূলীয় বেড়িবাঁধ ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাছাড়া বাঁধের ভাঙন ঠেকাতে বসানো কংক্রিটের ব্লক সরে গিয়ে বেড়িবাঁধের তিনটি স্থানে ১ হাজার ৮০০ মিটার বাঁধ ভেঙে গেছে।

বাঁধের ভাঙা অংশ দিয়ে প্রতিদিন জোয়ারের লোনাপানি উপকূলীয় এলাকায় ঢুকে পড়ছে। এতে চরম দুর্ভোগে পড়েছে স্থানীয়রা ।

পাশাপাশি জোয়ারের সময় সাগরের পানির আঘাতে প্রতিনিয়ত ভেঙে পড়ছে বেড়িবাঁধের মাটি। চলতি শুষ্ক মৌসুমে ভাঙা বেড়িবাঁধ মেরামত করা না হলে বর্ষা মৌসুমে পুরো বেড়িবাঁধ ভেঙে বিলীন হয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা স্থানীয়দের।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, সীতাকুণ্ডের সাগর উপকূলীয় এলাকায় মোট ২৬ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ রয়েছে। প্রায় এক যুগ আগে অব্যাহত ভাঙনের ফলে বিলীন হয়েছে এ বাঁধের বিভিন্ন অংশ। ভেঙে যাওয়া বাঁধের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত ছিল বাঁশবাড়িয়া ইউনিয়নের আকিলপুর, সোনাইছড়ির ঘোড়ামরা, কুমিরার আলেকদিয়ার সাগর উপকূলীয় বেড়িবাঁধ। বাঁধের ভেঙে যাওয়া অংশ দিয়ে প্রতিনিয়ত জোয়ারের পানি ঢুকে প্লাবিত হতো উপকূলীয় এলাকার বাড়িঘর। লবণাক্ত পানি ঢোকার কারণে চাষাবাদ বন্ধ হয়ে অনাবাদি অবস্থায় পড়ে ছিল হাজার হাজার একর জমি।

বাঁধ সংস্কারের দাবিতে স্থানীয় বাসিন্দাদের নিয়ে মানববন্ধন, সভা-সমাবেশসহ নানা ধরনের কর্মসূচি পালন করেন বাঁশবাড়িয়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান শওকত আলী জাহাঙ্গীর। তাঁদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ২০২০ সালে আকিলপুরের ক্ষতিগ্রস্ত দুই কিলোমিটার বেড়িবাঁধ পানি উন্নয়ন বোর্ড পুনর্নির্মাণ করে। কিন্তু অবহেলিত রয়ে যায় সোনাইছড়ি ইউনিয়নের উত্তর ঘোড়ামরা ও দক্ষিণ ঘোড়ামরা, সিকদার খাল ও কুমিরা আলেকদিয়া বেড়িবাঁধের ভাঙা অংশ।

স্থানীয়রা আরও জানান, ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের কারণে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসের প্রভাবে পুনরায় নির্মাণ করা আকিলপুর বেড়িবাঁধের ১ হাজার ২০০ মিটার অংশে কংক্রিটের ব্লক সরে যাওয়ার পাশাপাশি মাটি সরে ভেঙে গেছে পুরো অংশ। পাশাপাশি ভেঙে গেছে উত্তর ঘোড়ামরা, দক্ষিণ ঘোড়ামরা এবং সিকদার খাল এলাকার অন্তত ৬০০ মিটার বেড়িবাঁধ। এ ছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সিকদার খাল এলাকার একটি স্লুইসগেট।’

পাউবোর সহকারী প্রকৌশলী এস এম তারেক বলেন,আমরা ইতিমধ্যে বেড়িবাঁধের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণের পর তা প্রতিবেদন আকারে প্রধান কার্যালয়ে পাঠিয়েছি। বরাদ্দ পেলে দ্রুত সংস্কারকাজ শুরু করা হবে।

সীতাকুণ্ড উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শাহাদাত হোসেন বলেন, আমি ভেঙ্গে যাওয়া তিনটি বেড়িবাঁধের ক্ষতিগ্রস্ত অংশ ঘুরে দেখেছি। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। এ ছাড়া ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য পাউবোকে বলা হয়েছে।

খালেদ / পোস্টকার্ড ;