নির্বাচনে কারও মুখ দেখে নয়, অতীতের আমলনামা দেখে মনোনয়ন দেওয়া হবে

নির্বাচনে কারও মুখ দেখে নয়, অতীতের আমলনামা দেখে মনোনয়ন দেওয়া হবে
নির্বাচনে কারও মুখ দেখে নয়, অতীতের আমলনামা দেখে মনোনয়ন দেওয়া হবে

সমীরণ রায় ।।

নেতাকর্মীদের নির্বাচনের প্রস্তুতির নির্দেশনা দিয়েছেন দলের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে দলীয় নেতাকর্মীদের এলাকায় যাওয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন দলীয় প্রধান।

আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভায় তিনি বলেন, আগামীতে দলীয় মনোনয়ন কোনো ব্যক্তির সুপারিশে হবে না। মনোনয়ন দেওয়া হবে জরিপের ভিত্তিতে। এ সময় তিনি জেলা-উপজেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকদের ভারমুক্ত করার ঘোষণা দেন।

রোববার প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে আওয়ামী লীগের বিশেষ বর্ধিত সভায় তিনি তৃণমূল পর্যায়ের নেতাদের এ নির্দেশনা দেন। এ সভায় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য, উপদেষ্টা পরিষদ, আওয়ামী লীগের জেলা, মহানগর, উপজেলা ও পৌরসভা ইউনিটের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক, সংসদ সদস্য, জেলা ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার মেয়র, সহযোগী সংগঠনের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকরা উপস্থিত ছিলেন।

সভার শুরুতে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বক্তৃতা করেন। অনুষ্ঠানে ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া শোক প্রস্তাব উপস্থাপন করেন। এ সভায় আওয়ামী লীগের প্রায় ৩ হাজারের বেশি নেতাকর্মী ও নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি অংশ নেন। সকাল সাড়ে ১০টা থেকে বিকাল পৌনে ৫টা পর্যন্ত এ সভা চলে। এতে অন্তত তৃণমূল পর্যায়ের ৪৩ জন নেতাকর্মী বক্তব্য রাখেন। এ সময় আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা তাদের বক্তব্য মন দিয়ে শোনেন। পরে তিনি নেতাকর্মীদের আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে দিকনির্দেশনা দেন।

সভা সূত্র জানায়, দলীয় নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্য করে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বলেন, যাদের এলাকার জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ততা রয়েছে, যারা নিজের ভাগ্যোন্নয়নের কথা চিন্তা না করে এলাকায় মানুষের জন্য কাজ করেছেন, তাদের আগামীতে দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হবে। যাকে দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হবে, তার পক্ষে সবাইকে কাজ করতে হবে। ইতিমধ্যে সারা দেশের সার্ভে রিপোর্ট আমার কাছে এসেছে। কারও কারও বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। আমি কারও নাম বলতে চাই না। তবে এখনও সময় আছে। আপনারা এলাকায় যান। এলাকায় গিয়ে জনগণের দোরগোড়ায় যান। আরও সার্ভে করা হবে। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠবে তাদের এবার আর মনোনয়ন দেওয়া হবে না। বিগত দিনে দেখা গেছে, অনেকেই নিজের যোগ্যতা না থাকা সত্যেও দেশের বিজ্ঞ ও গুণিজনদের সুপারিশ নিয়ে আমার কাছে হাজির হন। এবার আর কারও সুপারিশে কাজ হবে না। কারণ সামনের নির্বাচন অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের সবার ভাগ্য নির্ভর করবে আগামী নির্বাচনের জয়ের ওপর। ইতিমধ্যে বিএনপি-জামায়াত আস্ফালন শুরু করেছে। তারা কোনোভাবে জয়ী হলে অনেকের সমস্যা হবে, তা মোকাবিলা করা কঠিন হবে। ফলে এখন সময় আছে শুধরে যান।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, নির্বাচনে কারও মুখ দেখে নয়, অতীতের আমলনামা দেখে মনোনয়ন দেওয়া হবে। একই সঙ্গে নৌকার ভোটের সঙ্গে প্রার্থীর নিজস্ব ভোট ব্যাংক আছে কি না তা যাচাই করেই দলীয় প্রার্থী চূড়ান্ত করবে আওয়ামী লীগ। নিজ যোগ্যতায় পাস করতে পারবে এমন যোগ্য প্রার্থীদেরকেই আগামী সংসদ নির্বাচনে দলের প্রার্থী করা হবে। একই সঙ্গে প্রতিটি আসনে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য, দলীয় মনোনয়নপ্রত্যাশীদের এলাকায় গিয়ে কাজ করার নির্দেশ দেন দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা। নিজ নিজ এলাকায় জনগণের কাছে সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের প্রচারের পাশাপাশি নির্বাচনের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে নির্দেশ দেন দলীয় প্রধান।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশি-বিদেশি নানা ষড়যন্ত্র চলছে, এসব মোকাবিলা করতে হলে দলে ঐক্য বজায় রাখতে হবে। আর ঐক্যবদ্ধ থাকলে কোনো ষড়যন্ত্র করেই আওয়ামী লীগকে কেউ রুখতে পারবে না। আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে-সেই নির্বাচনে দল মনোনীত প্রার্থীদের নিজ যোগ্যতায় পাস করে আসতে হবে।

বিএনপি-জামায়াত জোটের অপপ্রচার রুখতে সরকারের উন্নয়নের প্রচারে কাজ করতে নির্দেশ দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, আপনারা সারা দেশের জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ুন। সাধারণ মানুষের মধ্যে গত সাড়ে ১৪ বছরে আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে এলাকাভিত্তিক উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরুন। এলাকার জনগণের কাছে যান। এ সময় বিএনপি-জামায়াত জোটের নির্বাচন ঠেকানোর নামে জ্বালাও-পোড়াও, অগ্নিসন্ত্রাসের কথা মানুষের কাছে তুলে ধরারও পরামর্শ দেন তিনি।

দলীয় কোন্দলের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, নির্বাচন আসন্ন এখন সব দ্বন্দ্ব-কোন্দল ভুলে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। কেউ দ্বন্দ্ব নিরসন না করে উসকানি দিলে তার বিরুদ্ধে নেওয়া হবে সাংগঠনিক ব্যবস্থা। কারণ আওয়ামী লীগ ঐক্যবদ্ধ থাকলে কোনো ষড়যন্ত্রই কাজে আসবে না। এ সময় দলের ত্যাগী ও পোড়খাওয়া নেতাদের অর্থ-বিত্তের অভাব থাকতে পারে কিন্তু তাদের দল থেকে বাদ দেওয়া যাবে না। তাদের রেখেই কমিটি করতে হবে। তবে আওয়ামী লীগের সভাপতি এ সময় প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর চরিত্র হননের বিষয়ে নিষেধ করেন। নির্বাচনে প্রার্থী হতে গিয়ে বর্তমান এমপি বা কোনো সিনিয়র নেতার বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করতে নিষেধ করেন দলীয় প্রধান।

সভায় উপস্থিত নেতারা জানান, তৃণমূল নেতাদের মান-অভিমানের বিষয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতি আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দলীয় এমপি ও মনোনয়নপ্রত্যাশী নেতাদের নিজেদের মধ্যে কুৎসা বিষোদাগার না করে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার নির্দেশ দেন।

শেখ হাসিনা বলেন, আপনারা নিজেদের মধ্যে প্রকাশ্যে কোনো কুৎসা-বিষোদগার করবেন না। সরকারের আর্থ-সামাজিক অগ্রগতি উন্নয়ন অর্জনের তথ্য জনগণের কাছে তুলে ধরবেন। জনগণের কাছে যান, তাদের ভালোবাসা অর্জন করুন। জনগণের ভালোবাসা অর্জন করেই ভোটের মাধ্যমে জিততে হবে। অন্যভাবে কারও জেতার সুযোগ নেই। আমি বিভিন্ন সংস্থা মারফত প্রতি ছয় মাস অন্তর অন্তর তৃণমূলের জরিপ সংগ্রহ করে রাখছি। জনগণের কাছে অধিক জনপ্রিয় গ্রহণযোগ্যরাই মনোনয়ন পাবেন। কানা-খোড়া-ল্যাংড়া যাকেই নৌকা দেব-আপনারা তার পক্ষেই ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করবেন। আর না কাজ করলে ২০০১ সালের মতো পরিণতি হবে। কেউ ঘরবাড়িতে থাকতে পারবেন না। আগামী ২ সেপ্টেম্বর সিলেট সফরের মধ্য দিয়ে নির্বাচনি আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করবে আওয়ামী লীগ।

পিরোজপুর জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক কানাই লাল বিশ্বাস তাকে ভারমুক্ত করার আহ্বান জানালে আওয়ামী লীগ সভাপতি সারা দেশে যারা ভারপ্রাপ্ত হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে তাদের সবাইকে ভারমুক্ত করা হলো বলে ঘোষণা দেন। সিলেট বিভাগের নেতারা ভূমিহীন-গৃহহীনদের জমিসহ ঘর উপহার বিষয়ে স্থানীয় সংসদ সদস্য ও সরকারি কর্মকর্তারা তাদের সঙ্গে কোনো পরামর্শ করেন না বলে অভিযোগ করেন।

দিনাজপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আলতাফুজ্জামান মিতা তার এলাকার এক এমপির নাম উল্লেখ না করে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন। তিনি বলেন, ওই এমপি আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে কথা বলেন। তিনি আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তি নষ্ট করছেন।

সভায় দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনার কাছে স্থানীয় এমপিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে ধরে যশোর জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি শহিদুল ইসলাম মিলন বলেন, আওয়ামী লীগ আজ দুই ভাগে বিভক্ত। একটা হলো আওয়ামী লীগ, আরেকটা আমি লীগ। নৌকা নিয়ে পাস করে জনপ্রতিনিধি হওয়ার পর আর কোনো খবর থাকে না। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের পাশে চাপতে দেওয়া হয় না। নিজের বলয় তৈরি করতে মরিয়া থাকে। টিআর-কাবিখা দলের কোনো নেতাকর্মী পায় না। বিএনপি-জামায়াতের লোকজন সরকারি চাকরি হয় আর আওয়ামী লীগের কর্মীদের হয় না। কারণ বিএনপি-জামায়াতের লোকজন টাকা বেশি দেয়, আওয়ামী লীগের কর্মীরা টাকা দেয় না বলে চাকরি হয় না। নৌকা নিয়ে পাস করে জনপ্রতিনিধি হওয়ার পরে দলের বিপক্ষে কাজ করে স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে কাজ করে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার গোমস্তাপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি গোলাম মোস্তফা বিশ্বাস বলেন, কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ কোনো নির্দেশনা দিলে তা বাস্তবায়ন হয় না। শুধু ফর্মালিটি করা হয়। কমিটিতে আসার পরে শুধু নিজকে নিয়ে ব্যস্ত থাকে, নিজের কথার গুরুত্ব দেয় দলের না, নেতাকার্মীদের গুরুত্ব না দিয়ে মাইম্যান কথায় সব করে। যারা সংগঠনের জন্য কাজ করে না তারা কীভাবে যেন কমিটিতে চলে আসে। এ জন্য একটা শক্তিশালী মনিটরিং টিম করারও অনুরোধ করেন।

হবিগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আলমগীর বলেন, জনগণ বলে শেখ হাসিনা ভোট দেব কিন্তু এলাকার নেতাদের নয়। কারণ তারা নির্বাচিত হওয়ার পরে এলাকায় যেতে চায় না। মানুষকে সেবা দেয় না, নিজেরা নিজেরা বিশৃঙ্খলা করে।

গাজীপুর সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি রীনা পারভীন বলেন, উপজেলা চেয়ারম্যানের সঙ্গে এমপিদের সম্পর্ক খারাপ এবং তা দৃশ্যমান। উপজেলা চেয়ারম্যানের সঙ্গে স্থানীয় এমপি, মন্ত্রীরা সমন্বয় করে না। মানুষ যখন আসে, তখন আশানুরূপ সেবা দেওয়া যায় না। তাই সমন্বয় করে কাজ করলে ভালো হবে।

বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট তালুকদার ইউনুস বলেন, স্থানীয় নেতাকর্মী যখন নৌকার পক্ষে কাজ করে এবং নৌকার প্রার্থী জনপ্রতিনিধি হওয়ার পরে নেতাকর্মী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান। তারপর পাশে নেতাকর্মী চাপতে পারে না। এ জন্য নিজেদের মধ্যে কোন্দল বাড়ছে, দূরত্ব্ বাড়ছে, নেতাকর্মীদের মধ্যে ক্ষোভও বাড়ছে।

সিরাজগঞ্জ জেলায় আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক আবদুস সামাদ তালুকদার বলেন, দলের মধ্যে কোনো বিভাজন রাখা যাবে না। এমপি-নেতাদের সঙ্গে সমন্বয় করতে কাজ করতে হবে। আওয়ামী লীগ ঐক্যবদ্ধ হলে কোনো শক্তি নেই আওয়ামী লীগকে পরাজিত করে। বিভিন্ন কারণে ভুল বোঝাবুঝি হয় তা নিরসন করতে হবে।

পরে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নেতাকর্মীদের উদ্দেশে বলেন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে টানা চতুর্থ মেয়াদে সরকার গঠনের লক্ষ্যে ভোটযুদ্ধে শামিল হবে। তিনি তৃণমূল নেতাদের শপথ নেওয়ার কথা বলেন। এ সময় দ্বাদশের ভোটযুদ্ধে নৌকার জয়ের ধারাবাহিকতা ধরে রাখার লক্ষ্যে তৃণমূলের নেতারা বিভেদ ভুলে নৌকার পক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার শপথ নেন।

উল্লেখ্য, প্রতিটি জাতীয় নির্বাচনের আগে দলের নেতাদের নির্দেশনা দিতে এ ধরনের সভা করে আওয়ামী লীগ। ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনের আগে ২০১৭-এর ২৩ জুন এ ধরনের সবশেষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। দৈনিক সময়ের আলো

খালেদ / পোস্টকার্ড ;