শিক্ষিকার বেতন বাকী ১০ মাস, সীতাকুণ্ডের ত্রিপুরা পাড়ার বিদ্যালয়ের ৬০ শিশু লেখাপড়া বঞ্চিত

শিক্ষিকার বেতন বাকী ১০ মাস, সীতাকুণ্ডের ত্রিপুরা পাড়ার বিদ্যালয়ের ৬০ শিশু লেখাপড়া বঞ্চিত
শিক্ষিকার বেতন বাকী ১০ মাস, সীতাকুণ্ডের ত্রিপুরা পাড়ার বিদ্যালয়ের ৬০ শিশু লেখাপড়া বঞ্চিত

বিশেষ প্রতিবেদক ।।

সীতাকুণ্ডের সোনাইছড়ি ইউনিয়নের পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত ত্রিপুরা পাড়ার বিদ্যালয়টি ১ মাস ধরে বন্ধ রয়েছে। দশ মাসের বেতন না পাওয়ায় ও বেতন বৃদ্ধির দাবিতে বিদ্যালয় ছেড়ে দুই শিক্ষিকা চলে যাওয়া্র পর থেকে সেখানকার ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর অন্তত ৬০ শিশু পড়াশোনা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। শিশুদের অভিভাবকরা সন্তানের পড়াশোনা নিয়ে চরম অনিশ্চয়তায় ভুগছেন। তারা আশঙ্কা করছেন, তবে কি ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার একমাত্র বিদ্যালয়টি স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে গেল ?

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, সীতাকুণ্ডের দক্ষিণ সোনাইছড়ি ত্রিপুরা পাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৫টি কক্ষে তালা ঝুলছে গত ১ মার্চ থেকে । এর আগে দুইজন শিক্ষিকা বিদ্যালয়টিতে পাঠদান করলেও নিজেদের ১০ মাসের বেতন না পেয়ে তারা পদত্যাগ করেছেন। এরপর থেকে বিদ্যালয়টি সম্পূর্ণ বন্ধ রয়েছে। ওই বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ৬০ জন। যারা অনেক দিন শিক্ষার আলো থেকে দূরে ছিল।পড়াশোনা করা ছিল তাদের কাছে স্বপ্নের। বিদ্যালয়টিতে প্রাক-প্রাথমিক (শিশু শ্রেণি থেকে দ্বিতীয়) পর্যন্ত পড়াশোনা করার সুযোগ ছিল ত্রিপুরা পাড়ার শিশুদের। কিন্তু বিদ্যালয় বন্ধের মধ্য দিয়ে এবার শিশুদের বিকাশের পথ রুদ্ধ হয়ে গেল ।

বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, ২০১৮ সালে সীতাকুণ্ডের তৎকালীন ইউএনও প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের ‘সমতলে বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন প্রকল্পের’ আওতায় সোনাইছড়ি ইউনিয়নের মধ্যম সোনাইছড়ি ত্রিপুরা পাড়ায় সরকারি খাস জমিতে প্রাথমিক বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেন। ওই বছরের নভেম্বরে একজন মাত্র শিক্ষিকা দিয়ে বিদ্যালয়টির পাঠদান শুরু হয়। সেসময় বিদ্যালয়ে আশেপাশের এলাকা থেকে মুসলিম শিক্ষার্থীরাও ভর্তি হতে থাকে। সবমিলিয়ে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সংখ্যা ১২০ জনে দাঁড়ায়। পরে ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে আরেকজন শিক্ষিকা নিয়োগ দেয়া হয়। এভাবে বেশ ভালোই চলছিল বিদ্যালয়টির পাঠদান ও অন্যান্য কার্যক্রম। ত্রিপুরা পাড়ার শিশুরা আলোর পথ দেখতে শুরু করে ।

২০২০ সালে করোনাকালেও দুই শিক্ষিকা যথাসম্ভব ক্লাস নিয়ে শিশুদের পড়াশোনা চালিয়ে নিয়েছেন। তাদের শারীরিক, মানসিক বিকাশ যেন বাধাগ্রস্ত হতে না পারে সেজন্য পড়াশোনা থেকে বঞ্চিত করেননি শিক্ষিকারা। কোভিডের কারণে দীর্ঘ দিন বন্ধ থাকার পর ২০২১ সালে পুনরায় চালু হয় দক্ষিণ সোনাইছড়ি ত্রিপুরা পাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়টি। কিন্তু দুই শিক্ষিকার ১০ মাসের বেতন বকেয়া থেকে যায়।

এখানে উল্লেখ্য যে, ২০২২ সালের জুনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনন্য উদ্যোগ সমতল ভূমিতে বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নের লক্ষ্য বিশেষ এলাকার উন্নয়ন সহায়তা কর্মসূচির আওতায় উপজেলা ভিত্তিক বরাদ্দ দেয়া হয়। ওই বরাদ্দে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের শিক্ষাবৃত্তি, বাইসাইকেলসহ ২ শিক্ষকের ৩ বছরের সম্মানিসহ সর্বমোট ৯ লক্ষ টাকার বেশি বরাদ্দ দেয়া হয়। যার মধ্যে শিক্ষকদের সম্মানি ৩ লাখ ৭০ হাজার টাকা বলেও উল্লেখ করা হয়। সেইসাথে বলা হয় এ খাতে বরাদ্দের আর সুযোগ নেই। এক্ষেত্রে বিদ্যালয়ের নিজস্ব আয় সৃষ্টির সংস্থানের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে বলে জানা যায় ।

স্কুলের বিভিন্ন প্রসঙ্গ নিয়ে শিক্ষিকা তুলতুল আক্তারের সাথে কথা হয় । তিনি বলেন, ১০ মাসের বেতন বন্ধ থাকার পরও আমরা ক্লাস চালিয়ে নিয়েছি। পাঠদানে চেষ্টার কখনও কমতি রাখিনি, কার্পণ্য করিনি। আমার সহকর্মী প্রিয়াংকা মাতৃত্বকালীন সময়েও ক্লাস নিয়েছেন। আসা-যাওয়া ৩ কিলোমিটারের দুর্গম পাহাড়ি পথ পাড়ি দিয়ে আমরা বিদ্যালয়ে যেতাম। এতে সীমাহীন কষ্ট পোহাতে হতো। ২০২২ সালে পুরো ক্লাস নিয়েছি। মাত্র ৫ হাজার টাকা বেতনে আমাদের কিছুতেই পোষাত না। এই স্বল্প টাকা আমাদের যাতায়াত ভাড়াও মেটানো দায় হয়ে পড়ত। আমরা বারবার বলে আসছি বেতন বাড়ানোর কথা। তার উপর ১০ মাসের বেতন বন্ধ। সংসারে ছেলে মেয়েদের নিয়ে চলতে পারছিলাম না। কিন্তু উপজেলা প্রশাসনসহ কেউ আমাদের কথা কানে নেয়নি। তাই বাধ্য হয়ে পদত্যাগ করেছি।

তিনি আরও বলেন, এমনিতেই বেতন কম তার উপর বিদ্যালয়ে কোনো অফিস সহকারী নেই। সব কাজ আমাদের করতে হতো। কোন কিছু প্রয়োজন হলে সেগুলো আনতে হতো নিজেদের টাকায়৷ এসডিএ নামক একটি এনজিও ব্ল্যাকবোর্ড দিয়েছে। কারও কোন নজর নেই বিদ্যালয়ের প্রতি। একটি ফ্যান নেই, বিদ্যুৎ নেই।

অন্য শিক্ষিকা প্রিয়াংকা রাণী নাথ বলেন, সামান্য বেতন আমাদের। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির এই সময়ে কীভাবে জীবন চালাব। আমাদের কোন সুযোগ-সুবিধাই দেয়া হচ্ছে না৷ তার উপর মূল বেতনও দিচ্ছে না। বিদ্যালয়ের জন্য একটি ঝাড়ু কিনতে হলেও নিজের টাকা খরচ করে কিনতে হয়। বারবার প্রশাসনকে জানিয়েছি আমাদের সমস্যার কথা। তারা কর্ণপাত করেননি। উল্টো বলা হয়েছে আটকে যাওয়া বেতন নাকি পাব না।

ত্রিপুরা পাড়ার ভারপ্রাপ্ত সর্দার কাঞ্চন ত্রিপুরা বলেন, বিদ্যায়লটি ২০১৮ সালে প্রতিষ্ঠা করা হলেও উপজেলা প্রশাসনের কোনো নজর নেই। আমি নিজ উদ্যোগে বিদ্যালয়ে গাছ লাগাই, ফুলের চারা লাগাই। বিদ্যালয়ের আঙ্গিনা সবসময় পরিস্কার রাখি। কিন্তু কোনো সুযোগ সুবিধা দেয়া হয় না। শিশুরা মাঝে মাঝে বিদ্যালয়ে যায় আবার প্রায় বন্ধ থাকে। এভাবে তাদের পড়াশোনা ব্যাহত হচ্ছে। সারাবছর এক ধরণের অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলাম। এ পরিস্থিতিতে শিশুরা পড়াশোনায় নিরুৎসাহিত হচ্ছে। আস্তে আস্তে স্কুল থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে শিশুরা ।

জানা যায়, সীতাকুণ্ড উপজেলার সোনাইছড়ি ইউনিয়নের মধ্যম সোনাইছড়ি পাহাড়ের পাদদেশে ত্রিপুরা পাড়ায় ৭২টি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী পরিবারের বসবাস। গ্রামটির বর্তমান জনসংখ্যা প্রায় সাড়ে ৩শ’। শতাধিক ছেলেমেয়ে স্কুলে যাওয়ার উপযোগী হলেও অর্থাভাবে অনেকেই স্কুল থেকে ঝরে পড়েছেন। প্রতি বছর গ্রামটিতে ১৫-২০ শিক্ষার্থী স্কুল থেকে ঝরে পড়ে। কারণ হিসেবে সরকারি সুযোগ-সুবিধা না পাওয়া , প্রশাসনের সুনজরের অভাব ও দারিদ্র্যতাকেই দেখা হয়। যাতায়াতের পাহাড়ি ঢালু পথটি সংস্কারেও তেমন কোন সরকারি উদ্যোগ নেই। দীর্ঘ দিন ধরে গ্রামটি অন্ধকারে নিমজ্জিত। শত আশ্বাস, আশার বাণী শুনানো হলেও আজও সেখানে পৌঁছেনি বিদ্যুতের আলো ।

সীতাকুণ্ড উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. শাহাদাত হোসেন বলেন, শিক্ষিকাদের বেতন খুব সামান্য। তাই তারা চলে গেছেন। আর এজন্য বিদ্যালয়টি বন্ধ আছে। আমরা নতুন কোনো শিক্ষক পেলে নিয়োগ দেব। তাছাড়া পুরনো মাসের বেতন দেয়ার এখতিয়ার আমার নেই। আমার সময়কালে পুরো বেতন পরিশোধ আছে বলে জানান তিনি।

খালেদ / পোস্টকার্ড ;