এসেছে বসন্ত ভালোবাসায়

এসেছে বসন্ত ভালোবাসায়
এসেছে বসন্ত ভালোবাসায়,এই প্রথম দুই একসঙ্গে দিবস

নিজস্ব প্রতিবেদক।।

আজ পহেলা ফাল্গুন। উত্তুরে বায়ু নিয়েছে বিদায়, প্রকৃতি আজ দক্ষিণা দুয়ার খুলে দিয়েছে। সে দুয়ারে বইছে ফাগুনের হাওয়া। বসন্তের আগমনে কোকিল গাইছে গান। ভ্রমরও করছে খেলা। গাছে গাছে পলাশ আর শিমুলের মেলা। কবির ভাষায় ‘ফুল ফুটুক আর না-ই ফুটুক আজ বসন্ত’। আর এবারই প্রথম পহেলা ফাল্গুন আর বিশ্ব ভালোবাসা দিবস একই দিনে পড়ে গেছে। তাই এবার বসন্ত আর ভালোবাসার ‘মাখামাখির’ দিন।

আজ বিশ্ব ভালবাসা দিবস বা ভ্যালেন্টাইন ডে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় ‘আমার জীবনে তুমি বাঁচো ওগো বাঁচো/ তোমার কামনা আমার চিত্ত দিয়ে যাঁচো’ অথবা ‘তোমরা যে বল ভালোবাসা ভালোবাসা/ সখী ভালোবাসা কারে কয়’। কবির বাঁচা-মরার এবং চিত্র দিয়ে ভালোবাসা বোঝাবুঝির চিরন্তন বোধ আজ হয়তো একটু বেশিই অনুভূত হবে গোলাপ বিনিময় ও শরীরী ভাষায়। বসন্ত বাতাসে হৃদয়ের মিথস্ক্রিয়ায় সারা বিশ্বের প্রেমপিয়াসী যুগলরা বছরের এ দিনটিকেই বেছে নেয় মনের গহীনের কথকতার কলি ফোটাতে।

ফাল্গুনের হাত ধরেই ঋতুরাজ বসন্তের আগমন। ঋতুরাজকে স্বাগত জানাতে প্রকৃতির আজ এত বর্ণিল সাজ। বসন্তের এই আগমনে প্রকৃতির সঙ্গে তরুণ হৃদয়েও লেগেছে দোলা। সব কুসংস্কারকে পেছনে ফেলে, বিভেদ ভুলে, নতুন কিছুর প্রত্যয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার বার্তা নিয়ে বসন্তের উপস্থিতি। সে ফাগুনের মাতাল হাওয়া দোলা দিয়েছে বাংলার নিসর্গ প্রকৃতিতে। নতুন রূপে প্রকৃতিকে সাজাবে ঋতুরাজ বসন্ত। ফুলেল বসন্ত, মধুময় বসন্ত, যৌবনের উদ্দামতা বয়ে আনার বসন্ত আর আনন্দ, উচ্ছ্বাস ও উদ্বেলতায় মন-প্রাণ কেড়ে নেওয়ার আজ প্রথম দিন।

শীতের খোলসে ঢুকে থাকা কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া ও নাগলিঙ্গম এখন অলৌকিক স্পর্শে জেগে উঠেছে। মৃদুমন্দ বাতাসে ভেসে আসা ফুলের গন্ধে বসন্ত জানিয়ে দিচ্ছে, সত্যি সত্যি সে ঋতুর রাজা। লাল আর হলুদের বাসন্তী রঙের প্রকৃতির সঙ্গে নিজেদের সাজিয়ে আজ বসন্তের উচ্ছলতা ও উন্মাদনায় ভাসবে বাঙালি।

বসন্ত অনেক ফুলের বাহারে সজ্জিত হলেও গাঁদা ফুলের রঙকেই এদিনে তাদের পোশাকে ধারণ করে তরুণ-তরুণীরা। খোঁপায় শোভা পায় গাঁদা ফুলের মালা। বসন্তের আনন্দযজ্ঞ থেকে বাদ যায় না গ্রাম্যজীবনও। আমের মুকুলের সৌরভে আর পিঠাপুলির মৌতাতে গ্রামে বসন্তের আমেজ একটু বেশিই ধরা পড়ে। বসন্তকে তারা আরও নিবিড়ভাবে বরণ করে।

বসন্ত শুধু অশোক-পলাশ-শিমুলেই উচ্ছ্বাসের রঙ ছড়ায় না, আমাদের ঐতিহাসিক রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে শহীদদের রক্তের পুষ্পিত স্মৃতির ওপরও রঙ ছড়ায়। ১৯৫২ সালের আট ফাল্গুন বা একুশের পলাশরাঙা দিনের সঙ্গে তারুণ্যের সাহসী উচ্ছ্বাস আর বাঁধভাঙা আবেগের জোয়ার যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে।

মোগল সম্রাট আকবর প্রথম বাংলা নববর্ষ গণনা শুরু করেন ১৫৮৫ সালে। নতুন বছরকে কেন্দ্র করে ১৪টি উৎসবের প্রবর্তন করেন তিনি। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বসন্ত উৎসব। তখন অবশ্য ঋতুর নাম এবং উৎসবের ধরনটা এখনকার মতো ছিল না। তাই পহেলা ফাল্গুন বা বসন্ত উৎসব কেবল উৎসবে মেতে ওঠার সময় নয়। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাংলার গৌরবময় ঐতিহ্য ও বাঙালিসত্তা। সে ঐতিহ্যের ইতিহাসকে ধরে রাখতে পারলেই বসন্ত উৎসবের সঙ্গে সঙ্গে নতুন প্রজন্ম ছড়িয়ে দিতে পারবে বাঙালি চেতনাকে।

বঙ্গাব্দ ১৪০১ সাল থেকে প্রথম ‘বসন্ত উৎসব’ উদযাপন করার রীতি চালু হয়। সেই থেকে জাতীয় বসন্ত উৎসব উদযাপন পরিষদ বসন্ত উৎসব আয়োজন করে আসছে। এ ছাড়া তরুণ-তরুণীরা বাংলা একাডেমি আয়োজিত একুশের বইমেলা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, শাহবাগ, চারুকলা চত্বর, পাবলিক লাইব্রেরি, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, ধানমন্ডি লেক ও বলধা গার্ডেন মাতিয়ে রাখবে সারা দিন। আজ দিনভর চলবে তাদের বসন্তের উচ্ছ্বাস প্রকাশ। ফোন, ফেসবুক ও টুইটারসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চলবে বসন্তের শুভেচ্ছা বিনিময়। আজ নানা আয়োজনে বসন্তকে বরণ করবে বাঙালি।

বসন্তের কিছু বর্ণিল আয়োজন : জাতীয় বসন্ত উৎসব উদযাপন পরিষদ বসন্তের নাচ, গান ও কবিতার পাশাপাশি প্রতিবাদী নাচ, গান ও আবৃত্তিরও আয়োজন করেছে। আজ সকালে চারুকলা অনুষদের বকুলতলায় শিল্পী আকরাম হোসেনের এস্রাজের সুর মূর্ছনা দিয়ে শুরু হবে বসন্ত আবাহনের দিন জুড়ে অনুষ্ঠানের প্রথমভাগের কর্মসূচি। এরপর থাকবে বসন্ত শোভাযাত্রা, আবির ও ফুলের প্রীতিবন্ধনীর পাশাপাশি থাকবে নাচ ও গানের আয়োজন। বিকাল সাড়ে ৩টা থেকে রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত একযোগে এ অনুষ্ঠান চলবে চারুকলা অনুষদের বকুলতলা, পুরান ঢাকার বাহাদুরশাহ পার্ক, লক্ষীবাজার ও ধানমন্ডি ৮ নম্বর রোড সংলগ্ন রবীন্দ্র সরোবরের উন্মুক্ত মঞ্চে।

আজ বিশ্ব ভালোবাসা দিবস : চন্ডিদাসের অনাদিকালের সেই সুর-‘দুহঁ করে দুহঁ কাঁদে বিচ্ছেদ ভাবিয়া/ আধতিল না দেখিলে যায় যে মরিয়া/ সখী কেমনে বাঁধিব হিয়া’ এ আবেদনও বাজবে আজ কারও কারও হৃদয়ে।

কারণ আজ বিশ্ব ভালোবাসা দিবস বা ভ্যালেন্টাইন ডে। এ দিনেই প্রেমদেব কিউপিড প্রেমশর বাগিয়ে হৃদয় কন্দরে ঘুরে বেড়াবেন। সে অনুরাগেই প্রেমপাগল প্রেমিক-প্রেমিকারা পরাণ তাড়িত হয়ে বিদ্ধ হবে দেবতার বাঁকা ইশারায়। তাদের মনে লাগবে দোলা, ভালোবাসার রঙের রাঙাবে হৃদয়। ভালোবাসা উৎসবে মুখর হবে জনপদ। বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশেও আজ পালিত হচ্ছে দিবসটি। প্রযুক্তির কল্যাণে হাইটেক ডিজিটালের যুগে মোবাইল ফোনের ক্ষুদ্র বার্তা, ই-মেইল অথবা ফেসবুকে পুঞ্জ পুঞ্জ প্রেমকথার কিশলয় পল্লবিত হবে আজ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে রবীন্দ্র সরোবর পর্যন্ত রাজধানী ঢাকার আনাচে-কানাচে এমনকি সারা দেশের পার্ক ও বিনোদন কেন্দ্রগুলো সরব হচ্ছে প্রেমিক-প্রেমিকাদের পদচারণায়। হয়তো কবির ভাষায় একে অন্যকে বলবে- ‘তোমাকে ভালোবাসি আমি। ভালোবেসে সখী নিভৃত যতনে আমার নামটি লিখো তোমার মনের মন্দিরে’।

পশ্চিমা দুনিয়ায় ভ্যালেন্টাইন ডে বা প্রেম উৎসব তারুণ্যের মাঝে এক অদেখা ভুবনের উত্তেজনা ছড়ায়। এদিনে চকলেট, পারফিউম, গ্রিটিংস কার্ড, ই-মেইল, মোবাইলের এসএমএসে প্রেমবার্তা, হিরার আংটি, প্রিয় পোশাক, খেলনা মার্জার, বইয়ের ভেতরে রাখা গোলাপের ইশারা বিনিময়ে হয়ে উঠবে তরুণ-তরুণীদের প্রথম অনুসঙ্গ। হয়তো আরও থাকবে নীল খামে হালকা লিপস্টিকের দাগ, একটি গোলাপ ফুল, ছোট্ট কোনো উপহার, আর ছোট্ট একটি চিরকুট। তাতে দু’ছত্র গদ্য বা পদ্যে প্রেমের ঊর্মি-‘ইউ স্টেপ ইন টু মাই হার্ট, টার্নিং ইট ফ্রম স্টোন’ অথবা ‘তুমি আমার সবটুকু গান/ ঝড়ের পরে একটু চুমু/ তাতে আছে সবটুকু প্রাণ’।

বাংলাদেশে ১৯৯৪ সাল থেকে দিবসটি বেশ ঘটা করে উদযাপন করা শুরু হয়। এদিন শুধু প্রেম বিনিময় নয়, প্রেমিক-প্রেমিকাদের মধ্যে গোপনে বিয়ের হিড়িকও পড়ে। রাজধানীর উদ্যান, বইমেলা, কফিশপ, ফাস্ট ফুড শপ, লং ড্রাইভ, অথবা নির্জন গৃহকোণে একান্ত নিভৃতে কাটান প্রেমকাতুর তরুণ-তরুণীরা। দিনটি যে শুধু তরুণ-তরুণীদের তা নয়, পিতামাতা-সন্তানদের ভালোবাসাও বড় মাত্রায় উদ্ভাসিত করে।

ভালোবাসার এই দিনের ইতিহাস খুঁজতে গিয়ে অনেক ধরনের কাহিনির কথা জানা যায়। প্রধান যে কাহিনি প্রচলিত আছে তা এক রোমান ক্যাথলিক পাদ্রি বা সন্তের কাহিনি। তার নাম সেন্ট ভ্যালেন্টাইন। তিনি ছিলেন একজন চিকিৎসক ও পাদ্রি। তখন রোমানদের দেবদেবীর পূজোর বিষয়টি ছিল মূখ্য। তারা বিশ্বাসী ছিল না খ্রিস্টান ধর্মে। কিন্তু খ্রিস্টান ধর্ম প্রচারের অপরাধে ২০৭ খ্রিস্টাব্দে সাধু ভ্যালেন্টাইনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় রোমের সম্রাট দ্বিতীয় ক্লডিয়াসের আদেশে। তবে তিনি যখন জেলে বন্দি, তখন ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা ভালোবাসার কথা জানিয়ে জেলের জানালা দিয়ে তাকে ছুঁড়ে দিত চিরকুট।

বন্দি অবস্থাতেই তিনি চিকিৎসার মাধ্যমে জেলারের অন্ধ মেয়েকে ফিরিয়ে দেন দৃষ্টিশক্তি। অনুমান করা হয় মেয়েটির সঙ্গে তার প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। মৃত্যুর আগে মেয়েকে একটি চিঠি লেখেন, সেখানে তিনি উল্লেখ করেন ফ্রম ইউর ভ্যালেন্টাইন বলে। অনেকের মতে, এই সাধু ভ্যালেন্টাইনের নামানুসারে পোপ প্রথম জুলিয়াস ৪৯৬ খ্রিস্টাব্দের ১৪ ফেব্রুয়ারিকে ‘ভ্যালেন্টাইন ডে’ হিসেবে ঘোষণা করেন। তথ্যসুত্র. দৈনিক সময়ের আলো ।