সূর্যগ্রহণ ও ঘূর্ণিঝড় ‘সিত্রাং’ : আতঙ্কে উপকূলীয় জনপদ, মঙ্গলবার ভোরে আঘাত হানবে সন্দ্বীপে
পোস্টকার্ড নিউজ ।।
রোববারই (২৩ অক্টোবর) পূর্ব-মধ্য বঙ্গোপসাগরের ওপর নিম্নচাপটি শক্তি বাড়িয়ে গভীর নিম্নচাপে পরিণত হবে। এরপর আরও শক্তি সঞ্চয় করে এটি সোমবার (২৪ অক্টোবর) ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হবে। এর নামকরণ করা হচ্ছে ‘সিত্রাং’। মঙ্গলবার ভোরের দিকে তিনকোনা দ্বীপ ও সন্দ্বীপের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ উপকূল অতিক্রম করবে এ ঘূর্ণিঝড়।
এদিকে ঘূর্ণিঝড় যতই উপকূলের দিকে ধেয়ে আসছে, ততই আতঙ্কে কাঁপছে উপকূল। একই দিনে ঘূর্ণিঝড় ও সূর্যগ্রহণের প্রভাবে ১৫ উপকূলীয় জেলায় ৫ ফুটেরও বেশি উচ্চতায় জলোচ্ছ্বাস হতে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে দেশের আবহাওয়া অধিদফতর।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পৃথিবী, চাঁদ ও সূর্য একই সরল রেখায় অবস্থান করলে, চন্দ্র ও সূর্যের মিলিত বলের প্রবল আকর্ষণে যে তীব্র জোয়ারের সৃষ্টি হয়, তাকে তেজ কটাল বা ভরা কটাল বা ভরা জোয়ার বলে। এই সময়ে সাধারণ সময়ের চেয়ে ৮/১০ ফুট উচ্চতায় জলোচ্ছ্বাসের আশঙ্কা থাকে।
আবহাওয়াবিদ মো. মনোয়ার হোসেন জানান, বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং মঙ্গলবার (২৫ অক্টোবর) উপকূলে আছড়ে পড়তে পারে। এদিনই আংশিক সূর্যগ্রহণ হবে। ফলে এবারের ঘূর্ণিঝড় শক্তিশালী হতে পারে। ঘূর্ণিঝড় ও সূর্যগ্রহণ একই সময়ে হওয়ায় জলোচ্ছাস হবার আশঙ্কা রয়েছে। এরই মধ্যে সমুদ্র বন্দরগুলোকে ৩ নম্বর দূরবর্তী হুঁশিয়ারি সংকেত জারি করা হয়েছে।
তিনি বলেন, গভীর নিম্নচাপটির বর্ধিতাংশ, অমাবশ্যা তিথি ও বায়ুচাপ পার্থক্যের আধিক্যের প্রভাবে উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, বরিশাল, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, নোয়াখালী, ফেনী, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার এবং তাদের অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরসমূহের নিম্নাঞ্চল স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ৩-৫ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হতে পারে। এ অবস্থায় উত্তর বঙ্গোপসাগর ও গভীর সাগরে অবস্থানরত সব মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারকে দ্রুত নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে এবং পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত সেখানে থাকতে বলা হয়েছে।
এদিকে গভীর নিম্নচাপের ফলে সারাদেশেই বৃষ্টিপাতের প্রবণতা বেড়েছে। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন রয়েছে। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্নস্থানে হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টিপাত হচ্ছে।
খুলনা পানি উন্নয়ন বোর্ড বলেন, খুলনা অঞ্চলের নদ-নদীতে পানির স্বাভাবিক মাত্রা থাকে ২ মিটারের কাছাকাছি। বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট জলোচ্ছাস এবং সূর্যগ্রহণের কারণে আরও দুই ফুট বেশি পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। সাধারণত বেড়ি বাঁধগুলো ৪ মিটার পানির উচ্চতা ঠেকিয়ে রাখতে সক্ষম। তবে কোথাও কোথাও বাঁধের অবস্থা খারাপ হওয়ায় তা অনেক নিচু অবস্থায় রয়েছে।
মোংলার কচুবনিয়া এলাকার বাসিন্দা জুলফিকার আলী বলেন, সকালের পর থেকেই গুড়িগুড়ি বৃষ্টি ছিল। এখন বৃষ্টি অনেক বেশি। পানিও বাড়া শুরু করেছে। আমাদের মধ্যে আতঙ্ক কাজ করছে। উপকূলের একদম কাছের ওই এলাকায় প্রায় ৩-৪ হাজার মানুষের বাস। তারা সবাই আতঙ্কে আছে বলে জানান তিনি।
এদিকে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে ভোলার উপকূলীয় এলাকায় গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। কোথাও কোথাও ভারী বর্ষণের খবর পাওয়া গেছে। তবে ঝড় মোকাবিলায় ভোলা পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছে বলে জানিয়েছেন নির্বাহী প্রকৌশলী হাসানুজ্জামান।
ভোলার উপকূলীয় বাসিন্দা দিনমজুর জাহিদুল ইসলাম বলেন, গতবছরের ঝড়ে আমার বাড়ির সব ভাইঙে গিসিলো। কোনো রহমে ঠিক কইরে থাহি। আবার নাকি ঝড় আসতিছে। ঝড় হলি পোলাপান নিয়ে স্কুলে যাইয়ে উঠবানি। ঝড় তো এখন আমাগে সঙ্গী মনে হয়। প্রতিবছর ঝড় আসে, বাঁধ ভাঙ্গে। গ্রামের সবাই মিলে বাঁধ দিই। তয় এবার ভয় করতিছে ভরা চান্দের সময় বলি।
চরফ্যাশন উপজেলার চর কুকরী-মুকরী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক মো. বাদশা মিয়া বলেন, দুপুরে স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে নদীর পানি কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে। ততই আতঙ্কে কাঁপছে উপকূল বাসিন্দারা।
অপরদিকে মনপুরা উপজেলার সিটিটির ওয়ারলেস অপারেটর মো. সহিদুল ইসলাম বলেন, ৩ নম্বর সিগনাল চলছে এটা পরিবর্তন হয়ে ৪ নাম্বারে উঠতে পারে। সর্বত্র গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হলেও এখন পর্যন্ত বড় কোন ঘটনার খবর পাওয়া যায়নি।
অপরদিকে চরফ্যাশন উপজেলার ঢালচরের ইউসুফ ফরাজী বলেন, সকাল থেকে বৃষ্টি হচ্ছে এবং আবহাওয়ার খবরে জেলেরা নৌকা নিয়ে সাগর থেকে ফিরতে শুরু করেছে। তবে সাগর উত্তাল রয়েছে।
ভোলা আবহাওয়া অধিদফতরের কর্মকর্তা মাহাবুবুর রহমান বলেন, সকাল থেকে ১ মিলিমিটারের কিছুটা বেশি বৃষ্টি হয়েছে। সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বিরাজ করছে। ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং মোকাবিলায় জেলায় ৬৯১টি আশ্রয় কেন্দ্র প্রস্তুত রয়েছে। সেগুলোর ধারণ ক্ষমতা ৫ লাখ ২৩ জন।
বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট নিম্নচাপটি আরও শক্তিশালী হয়ে গভীর নিম্নচাপে পরিণত হয়ে ঘূর্ণিঝড়ের আগের স্তরে রয়েছে। এটি আরও শক্তিশালী হলে সোমবার (২৪ অক্টোবর) সকাল নাগাদ ঘূর্ণিঝড় ‘সিত্রাং’-এ রূপ নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের গা ঘেঁষে বয়ে যেতে পারে।
খালেদ / পোস্টকার্ড;